একজন লেখক বিশেষ কিছু দেখাকে কেন্দ্র করে সচেতন-অচেতন এই দুই প্রক্রিয়ার মধ্যে ভারসাম্য রাখেন: ইশরাত তানিয়া


অলঙ্করণ: লংরিড

ইশরাত তানিয়া। কথাসাহিত্যিক ও প্রবন্ধসাহিত্যিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো ‘নেমেছ ইচ্ছে নিরিবিলি’, ‘বীজপুরুষ’, ‘মদ এক স্বর্ণাভ শিশির’। বিভিন্ন কাগজে নিয়মিত গল্প, গদ্য ও প্রবন্ধ লিখছেন। সম্প্রতি তার নতুন গ্রল্পগ্রন্থ ‘মেলো ইয়েলো, শিউলিগাছ আর বারান্দা হচ্ছে’ প্রকাশিত হয়েছে। নতুন গ্রন্থ এবং সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক সাইফ বরকতুল্লাহ

সাইফ বরকতুল্লাহ: আপনার গ্রন্থগুলোর একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। বিশেষ করে নামগুলো অন্যরকম হয়। আপনার অভিমত বলুন-
ইশরাত তানিয়া: অন্য যেকোনো সচেতন লেখকের মতো আমাকেও গল্পের বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবতে হয়। আখ্যান, উপস্থাপনা এবং সমাজের ভেতর অন্তর্গত দ্বন্দ্ব আর উদ্ভুত সংকটের পাশাপাশি দুর্বৃত্ত পুঁজিবাদের বিশ্বব্যাপী যে আগ্রাসন এবং সে ব্যবস্থার সাথে যখন আমাদের উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণি কিংবা বলা যেতে পারে জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তিক সম্প্রদায় জড়িত হয়, তখন বিষয়গুলো ডিল করা খুবই কঠিন। মাঝে মাঝে সংশয় জাগে আমার প্রিপারেশান কতটুকুই বা? তবু আমি চেষ্টা করি এ বিষয়গুলোকে যথাসম্ভব তুলে আনার। ফলে দেখাটা তোভিন্ন হতে বাধ্য। তাই বোধ হয় আমার গল্পের নামগুলো অন্যরকম বলে আপনাদের কাছে চিহ্নিত হয়।

সাইফ: আপনি যখন গল্প লেখেন, তখন ঠিক কোন বিষয়টির প্রতি বেশি মনোযোগ দেন?
ইশরাত তানিয়া: গল্প লেখার সময় অনেকগুলো বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হয়। এখানে লক্ষ্য করেছি ভাষা ও নিটোল কাহিনিকে প্রাধান্য দিয়ে গল্প লেখা হয়। যেন একটি বিষয়কে গুছিয়ে বলাই গল্প। আমার কাছে এগুলো প্রামাণ্য চিত্রছাড়া আর কিছুই না। আমি মনে করি একজন লেখক তাঁর বিশেষ কিছু দেখাকে কেন্দ্র করে সচেতন ও অচেতন এই দুই প্রক্রিয়ার মধ্যে ভারসাম্য রাখেন। ওই দেখাটাই এক সময় লেখককে চালিত করে। লেখক সব সময় সবজান্তা নাও হতে পারেন। গল্পগুলো লেখার পর পড়ে দেখি, আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়, ওই দেখাগুলোর সমন্বয় ঠিকঠাক মতো হয়েছে কি না আর আসলেই কি আমি সমষ্টির জন্য কিছু বললাম? এটুকুই।

সাইফ: সম্প্রতি জলধি আয়োজিত ‘পাঠ ও আন্তর্পাঠে মেলো ইয়েলো, শিউলিগাছ আর বারান্দা হচ্ছে’ অনুষ্ঠানে অগ্রজ কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ, নাসরীন জাহান, সালমা বাণী, নাসিমা আনিস, পারভেজ হোসেনসহ আরও কয়েকজন আপনার গল্পের বেশ প্রশংসা করলেন। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
ইশরাত তানিয়া: জলধি থেকে প্রকাশিত আমার তৃতীয় গল্পগ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বর্তমান বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন লেখক আমার গ্রন্থ আলোচনায় যে আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন, খুব কম তরুণ লেখকের জীবনে এরকম ঘটে। পরবর্তী সময়ে বার বার মনে হয়েছে এটা শুধু আমার ব্যক্তি পরিচয়ের কারণে হয়নি। জলধি এবং এর প্রকাশক কবি, কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক নাহিদা আশরাফীর গ্রহণযোগ্যতা একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

সাধারণত কোনো প্ল্যাটফর্মে বিভিন্নধারার লেখকরা আলোচনার ক্ষেত্রে এতোটা স্বতঃস্ফূর্ত হন না। বাংলাসাহিত্যের কীর্তিময়ী কথাশিল্পী নাসরীন জাহান যখন বলেন-‘ইশরাত তানিয়া যে আমার প্রিয় কথাসাহিত্যিক, আমার পরিচিতজনদের ভেতর কে না জানে?’ এ কথা শোনার পর অন্য তরুণদের মতো উচ্ছ্বসিত না হয়ে বরং সংহত হই। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সালমা বাণীর সংক্ষিপ্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে আমাকে যে আশীর্বাদ করেছেন- সেটাও অনেক বড় প্রাপ্তি। শ্রদ্ধেয় কথাসাহিত্যিক পারভেজ হোসেন তিনিও মন্তব্য করেছেন। এছাড়াও কথাসাহিত্যিক মনি হায়দারসহ অনেক গুণীজন আমার লেখা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করেছেন।

অনুষ্ঠানে যে আলোচনাটি সবচেয়ে জরুরি হয়ে উঠেছিলো- শুধু আমি না, সবার কাছেই-বাংলাদেশ ও বাংলা সাহিত্যের নানাবিধ দিক নিয়ে বলেছিলেন আশির ছোট কাগজ আন্দোলনের কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদ।তিনি ৪৭ পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্যের ধারাবাহিক গতিপ্রকৃতি বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া আট দশকের ছোটগল্পের ক্ষেত্রপট ধরে ঠিক এই সময়ের গল্প পর্যন্ত যৌক্তিক ও বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করেন।

আমি অপরাপর বিস্মিত হয়েছি, এরই মধ্যে আমার তিনটি বইয়ের ৪২ গল্প নিয়ে সেখান থেকে ৬টি গল্পকে উনি যেভাবে বিচার্য তালিকায় ফেললেন, তাতে আমিও জানতাম না যে, লেখায় একজন তরুণ লেখকের প্রবণতা এবং গণপাঠককূলের ভালোলাগা-মন্দলাগার বাইরেও একজন প্রকৃত শিল্পীর মতোই অন্য শিল্পীর শিল্পসত্তাকে এভাবে শনাক্ত করা যায়। বিশেষত সাম্প্রতিক বাংলা কথাসাহিত্যের জীবিত লেখকদের মধ্যে আমি যাকে বিকল্প অভিব্যক্তির অর্থাৎ বাঁক বদলের ধারায় সবচেয়ে প্রতিভাবান লেখক বলে মনে করি, তাঁর কাছ থেকে এমন মূল্যায়ন পাওয়া আমার দুর্লভ সৌভাগ্য। যদিও আমি জানি, আমার লেখা হয়তো সেই স্থান কিছুটা স্পর্শ করেছে সত্য, কিন্তু তারও অধিক, বাংলা ভাষার সাম্প্রতিককালের সুপঠিত সুপরিচিত ও অন্যতম প্রধান কথাশিল্পী নাসরীন জাহানের আমার লেখার প্রতি অসামান্য ভালোবাসা ও মনযোগের কারণে কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদ আমার ৪২টি গল্প পড়ে মেধা ও শ্রম দিয়ে এই মূল্যায়নটি করে গেলেন।

এখানে আরও উল্লেখ্য, সম্পূর্ণ বিপরীতধারার সমসাময়িক দুজন কথাশিল্পীর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আমাকে বিস্মিত করেছে।

এতটা নৈর্ব্যক্তিক এবং একইসাথে আত্মিক আলোচনার পর কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদের শনাক্তকৃত সেই ৬টি প্রতিনিধিত্বশীল গল্প (‘জুনাই বিবির অভিযোজন’, ‘বর্তমান অবর্তমানে’, ‘মদ এক স্বর্ণাভ শিশির’, ‘মেলো ইয়েলো, শিউলিগাছ আর বারান্দা হচ্ছে’, ‘গজ্ঞা ঠাকুরের সুগন্ধি’ এবং ‘অবনী বাড়ি নেই’) আমি বার বার পড়েছি এবং অনুভব করেছি আমার লেখকসত্তা এই প্রথম কেউ ধরিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ করছি গল্পগুলোর রচনাকাল ২০১৬ থেকে ২০২০।

শুধু তাই না, অবশ্যই এটা আমি করি, যা তিনি বললেন, সমাজ সংশ্লিষ্ট সংকটে আমার গল্পের চরিত্ররা সমষ্টির ভেতর থেকে বেরিয়ে ব্যক্তি স্কেপ করে, যা মূলত ট্রমা। আবার কখনো ব্যক্তি সমষ্টির প্রতিনিধিত্ব করার চেষ্টাও করে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, আমার ওপর তিনি পরোক্ষভাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করলেন। এমন কি তিনি যখন গল্পের চরিত্র চিত্রণ ও অন্যান্য চরিত্রের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় আমার যে আরও সচেতন হওয়া উচিৎ এ বিষয়টি তীব্রভাবে বলেন, তখন আমার কাছে অনেক পুরস্কার, সম্মাননার চেয়েও এই আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে অনেকেই তাঁর সাথে একমত পোষণ করেছেনবলে আমাকে জানিয়েছেন। বিশেষ করে গল্পে চরিত্রের সমতা রক্ষার ব্যাপারে।
আলোচনার শেষে চলে যাবার আগে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন ৬টি গল্পের মধ্যে বিশেষত ‘জুনাইবিবির অভিযোজন’, ‘মেলো ইয়েলো, শিউলিগাছ আর বারান্দা হচ্ছে’, এবং ‘মদ এক স্বর্ণাভ শিশির’ এই ৩টি গল্প সাম্প্রতিককালের কথাসাহিত্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মাত্রায় প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্য।

এই প্রশ্নটি যথার্থ করেছেন এই জন্য যে, আপনারা কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদের আলোচনাটি পড়লে বুঝবেন সাহিত্য আলোচনা কতোটা বিশ্বস্ত হতে পারে এবং একই সাথে অন্যান্য লেখকের মননকেও কতোটা শক্তিশালী করে তুলতে পারে। জলধি আয়োজিত এই অনুষ্ঠান, আমি মনে করি, আমার লেখকজীবনের ওপর একটা বড় প্রভাব ফেলবে।

সাইফ: আপনি তো কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলেন।কিন্তু দেখা যাচ্ছে কথাসাহিত্যে আপনার আগ্রহ বেশি। কবি না কথাসাহিত্যিক- কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
ইশরাত তানিয়া: কবিতাকে আমি ভালোবাসি। আমি মনে করি হৃদয়ের অন্তর্গত বিষয়গুলোকে কবিতাই ধারণ করতে পারে। এবং গদ্য লেখার ক্ষেত্রে আমি অবাক হয়ে দেখেছি কাব্যপনা নয়, কবিতার এমন কিছু অনুভব আছে যা গদ্যের সাথে সঙ্গতি করতে পারলে গদ্যের সমৃদ্ধি শুধু নয়, ওরহান পামুক লেখায় ‘ট্রিটমেন্ট’ বলে যে কথাটি বলেন, অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, আমার কবিতা লেখার আকাঙ্ক্ষাটা পরবর্তী সময়ে গদ্যকে মাত্রাদেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। যদিও আমি গদ্যের ঋজুতা কোনোভাবে ব্যাহত হোক সেটা চাই না। কবিতা আমার হৃদয়ের সাথে রয়েছে। আমার পরিশ্রুত অনুভূতি তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে কবিতা অনুকূল ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু আমি মনে করি অনেক ব্যবহারিক বিষয়ের প্রয়োজনে আমার মেধা ও শ্রম কথাসাহিত্যের দিকে ঝুঁকে গেছে। সে অর্থে নিজেকে আমি কথাসাহিত্যিক বলে মনে করি।

সাইফ: সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে কখনো কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন?যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, তারা কারা? কিংবা সেই প্রভাবের ধরনটি কেমন হতে পারে?
ইশরাত তানিয়া: আমি পরম্পরায় বিশ্বাসী। ছোটবেলা থেকে আজঅব্দি বাংলা সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের যেসব লেখকের সাহিত্য পড়েছি, আমি মনে করি, কোথাও না কোথাও প্রত্যেকের পরোক্ষ প্রভাব আমার লেখায় রয়েছে।

সাইফ: সময় দেওয়ায় আপনাকে শুভেচ্ছা।
ইশরাত তানিয়া: আপনাকেও আন্তরিক ধন্যবাদ।