নির্বাচিত দশ কবিতা ॥ সাদমান সজীব


যেদিন আমি থাকবো না

যেদিন আমি থাকবো না
সেদিন এমন কিছু মানুষ থাকবে
যাদের কাছে দিনটি হবে উৎসবের।
তারা বলবে-‘যাক, আপদ বিদায় হলো!’
অথচ কিছুতেই কারো মনে যেনো কষ্ট না লাগে
সে-চেষ্টাতেই জীবন গেলো।

যেদিন আমি থাকবো না
সেদিন ভিজবে তোমার চোখ ধূসর বাস্তবতায়
হতবিহ্বল হবে হৃদয় এক অচেনা মৌনতায়
তোমার মনে বাজবে তখন বিষণ্ণতার সুর
নাকি তুমিও থাকবে তাদের দলে
আর স্বপ্নসুখে বিভোর?

যেদিন আমি থাকবো না
দেখবে না আর কোথাও তুমি নতুন কোনো লেখা
থাকবে না আর অভিযোগ কোনো লেখা নিয়ে
ডায়েরিটা সাজবে সেদিন ধুলোর চিত্রকল্পে
দূরের ওই আকাশটাও কাঁদবে শোকে ভীষণ
প্রকৃতি তার ছন্দ হারিয়ে করবে অন্বেষণ।

কখনো যদি ভুল করে আমায় মনে পড়ে
খুলে দিও তুমি জানালা তোমার
আসবো আমি দক্ষিণা হাওয়া হয়ে।
রাশি রাশি যতো মেঘেদের দল
নীল আকাশে ওড়ে
আমাকে তুমি পাবে এদেরই ভিড়ে

কখনো যদি আমাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে জাগে ভীষণ
চলে এসো প্রিয় শ্রাবণ সন্ধ্যায়
ভিজবো আমি তোমার সাথে বৃষ্টির জল হয়ে।
যেখানে দেখবে বিন্দু বিন্দু শিশির কণা
জমে আছে এক অদ্ভুত সজীবতায়
সেখানেই তুমি পাবে আমায় নিশ্চুপ নীরবতায়

কখনো যদি লাগে তোমার ভীষণরকম একা
চলে এসো তুমি রাতের গভীরে
অগণিত নক্ষত্রের মাঝে পাবে আমার দেখা।
যখন রাতের অন্ধকারে পাবে তুমি ভয়
জোছনা হয়ে আসবো আমি
ভয়কে করতে জয়।

যেদিন আমি থাকবো না
অবহেলিত অসহায় যতো পথশিশু আছে
আমাকে তুমি পাবে তাদের প্রাণোচ্ছল হাসির মাঝে।
আমাকে তুমি আরও পাবে অন্যায়ের প্রতিবাদে
জগতে যতো দুঃখ-কষ্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে
আমি থাকবো সর্বত্রই যতোদিন তা থাকে।

আমি জানি

আমি জানি আর কখনোই
তোমার কাছে ভালো হয়ে উঠবো না
কেননা ভালোর সংজ্ঞাটাই এখন ভীষণ বিতর্কিত।

আমি জানি আর কখনোই
তোমার চোখে অশ্রুবিন্দু হয়ে ঝরবো না
কেননা অশ্রুবিন্দু এখন শুধুই নষ্টদের জন্য

আমি জানি আর কখনোই
তোমার স্বপ্নে রঙিন হয়ে সাজবো না
কেননা তোমার স্বপ্নে আমি ভীষণ বিবর্ণ

আমি জানি আর কখনোই
আমার চোখে শ্রাবণের মেঘ হয়ে জমবে না
কেননা অভিমানে মেঘগুলো আর জড়ো হয় না

আমি জানি আর কখনোই
ফুলগুলো সুবাস ছড়াবে না
কেননা নষ্টদের থাবায় ফুলগুলো এখন ক্ষত-বিক্ষত।

আমি জানি আর কখনোই
মানবিক বোধ জন্ম নেবে না
কেননা মানবতা এখানে নির্মমভাবে হেরে যায়।

আমি জানি আর কখনোই
স্বপ্নগুলো নীলিমা ছুঁয়ে হাসবে না
কেননা স্বপ্নেরা এখানে নৃশংসভাবে খুন হয়।

আমি জানি আর কখনোই
ভিন্ন আলোয় আলোকিত হবো না
কেননা এখানে অন্ধকার যেনো এক কৃষ্ণ গহ্বর।

বিশ্বাসের প্রতিদান

মানুষ নাকি সৃষ্টির সেরা
উন্নত এক জাতি,
আমরা হলাম তুচ্ছ প্রাণী
নাম দিয়েছে হাতি।

আমরা না হয় একটু বুঝি
তারা তো বুঝে বেশ,
তবে কেনো আমাদের হায়
জীবনটা হলো শেষ?

ক্ষুধার জ্বালায় মা যে আমার
খুঁজে পেলো আশ্বাস,
মনে অনেক আশা নিয়ে
তাদের করলো বিশ্বাস।

সহজ-সরল মা যে আমার
কোমলমতি এক ফুল,
তাদেরকে সে বিশ্বাস করে
করলো বিশাল ভুল।

আনারসে ভরা ছিলো
ঘাতক পটকাবাজি,
বিশ্বাস করে খেয়ে নিলো
জীবন রেখে বাজি।

নিজেকে নিয়ে না ভেবে
ভাবলো আমায় নিয়ে,
তাইতো আপ্রাণ চেষ্টা মায়ের
বাঁচাতে সব দিয়ে।

হলো না মা সফল এবার
মানুষ সফল হলো,
মানুষ হয়ে জন্মাইনি হায়
এটাই যে ভুল ছিলো।

মানুষ নিয়ে প্রশ্ন আমার
তারাই সৃষ্টির সেরা?
তাদের জন্যে পৃথিবীতে
আর হলো না ফেরা।

প্রাগৈতিহাসিক প্রণয়

সেদিন সূর্যটা ভীষণ রেগেছিলো
সেজেছিলো আকাশ রোদের উত্তপ্ত চাদরে
আকাশ যেনো আগুনের উৎসবে মেতেছে
পাহাড় তখন নীরবে দেখছে রোদের বীভৎস রূপ,
সূর্যের রাগ ভাঙার জন্যে মেঘের শত আয়োজন
মেঘ তখন বেদনার কাজল মেখে সাজালো তার চোখ
ঠিক তখনই মেঘের নূপুরের শব্দে প্রতিধ্বনিত হলো দিগন্ত
পৃথিবীর আর্তনাদ থামিয়ে অঝোর ধারায় ঝরলো বৃষ্টি;
পাহাড় তখন বৃষ্টির জলে ভিজে বিবর্ণ স্বপ্নের চূড়ায়
তার মনে মেঘকে ঘিরে অচেনা অনুভূতির সৃষ্টি হলো
কিন্তু মেঘকে কখনোই তা বলতে পারলো না
মেঘ যে তা বুঝতে পারেনি এমন নয়।

এমনি করে দিন গড়িয়ে রাত আসলো
রাত তখন জোছনায় ভিজে স্নান করছিলো
যেনো জোছনার সমুদ্রে রাতের অবগাহন।
পাহাড় তখন অবাক হয়ে দেখছে-
কীভাবে মেঘ জোছনার সাথে খেলা করছে
মেঘ আর জোছনার এ-খেলায় চাঁদ যেনো মুচকি হাসছে
তখন এক অনিন্দ্য স্নিগ্ধতায় ভরে গেলো চারপাশ
দূরের ওই পাখিগুলো অচেনা সুরে কী যেনো বলে যায়
তবুও মেঘের ঘোর অবুঝ পাহাড়কে বিচ্ছিন্ন করেনি;
এমনি করে বিবর্তনের স্রোতধারায় ভেসে যায় সময়
পাহাড় সেই স্রোতে হারিয়ে যায় অভিমানী মেঘের গহিনে।

হঠাৎ আগন্তুক হয়ে আসলো ঝড়ো হাওয়া
অদ্ভুত এক আঁধারে ছেয়ে গেলো আকাশ
দানবীয় চিৎকারে বজ্রের আবির্ভাব হলো
বজ্রের ভয়ে সবাই দিগ্বিদিক ছুটে গেলো
কিন্তু মেঘ তা পারলো না
বজ্র তাকে যেতে দিলো না
বজ্রের বাহুডোরে আটকে গেলো মেঘ
সেই থেকে মেঘ এখনো মুক্তির প্রতীক্ষায়।

মেঘের অশ্রুবিন্দু আজো বৃষ্টি হয়ে ঝরছে পৃথিবীতে
পাহাড় এসব দেখেও কিছু করতে পারছে না
যেনো তার ইচ্ছেগুলো অদৃশ্য শেকলে বাঁধা!
বোবা পাহাড়ের কান্না আজো ঝর্ণা হয়ে ঝরছে পৃথিবীতে
পাহাড়ের সেই অচেনা অনুভূতি আজো মানুষের হৃদয় জুড়ে থাকে
যার নাম ভালোবাসা।

একটি পাখির প্রেম

তোমার সাথে আজন্ম ওড়ার নেশায়
তোমার আকাশে এসেছিলাম একদিন
আজ তোমার খাঁচায় বন্দি আমি
হাজার হাজার পাখি তোমার সাথে উড়ে বেড়ায়
তোমাকে ছোঁয়, তোমার স্নিগ্ধতা উপভোগ করে
আমি খাঁচার ভেতর থেকে শুধু অপলক চেয়ে রই
হায় কী জীবন আমার।

তোমাকে না দেখার অসুখ

কতদিন তোমায় দেখি না
যেদিন তোমায় প্রথম দেখেছিলাম
সেদিন ক্লান্ত দু-চোখ বসন্তের রং ছুঁয়েছিলো

যেদিন তোমায় শেষ দেখেছিলাম
সেদিন বর্ষার রং আমায় ছুঁয়েছিলো
স্বপ্নগুলো ভেঙে পড়েছিলো অত্যন্ত নির্মমভাবে

তারপর কেটে গেলো অনেক সময়
তোমাকে না দেখার অসুখ আমাকে বিধ্বস্ত করে দিলো
বলে দিলো- তুমি আমার কতোটা প্রয়োজন।

এরপর তোমাকে দেখার জন্যে আমি বের হয়ে গেলাম
মহাবিশ্বের অজস্র গ্রহে, নক্ষত্রে তোমায় খুঁজলাম
তবু তোমার দেখা পেলাম না।

তখন আমার দু-চোখ জুড়ে অদ্ভুত অন্ধকার নেমে এলো
সেই অন্ধকার ক্রমশ আমার পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দিলো
দূর থেকে ভেসে আসলো আমাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কান্না।

তবে কি আর কখনোই তোমায় দেখবো না
না, অভিমানের দেয়াল ভেঙে ধূসর পথ পেরিয়ে
রঙিন স্বপ্নের ডানা মেলে তুমি ঠিক আসবে।

পৃথিবীর সব আলো তখন নিভে যাবে
সমস্ত সময় ঘুমিয়ে পড়বে
থাকবে শুধু অন্ধকার, তোমাকে দেখার।

আহত সুখ

প্রগাঢ় আঁধারের সিঁড়ি বেয়ে
অনিন্দ্য স্বপ্নের ডানায় চড়ে
শত আলোকবর্ষ পেরিয়ে
আমি যখন অন্য কোনো স্বপ্নের দরজায়,
ঠিক তখনই অজস্র স্নায়ুকোষ
বুনো উল্লাসে মেতে ওঠে
বেজে ওঠে রঙিন সুর
ভেসে আসে তোমার অবয়ব।

সেখান থেকে ঝরে পড়ে
অসংখ্য সবুজ স্নিগ্ধ স্বপ্ন,
সে স্বপ্নগুলো ক্রমশ
আমার মাঝে মিশে যায়,
সুপ্ত সব ইচ্ছেগুলো
ঘুম থেকে জেগে ওঠে;
এভাবেই প্রণয়ের ডালপালা
আমার মাঝে বেড়ে ওঠে!

তারপর হঠাৎ একদিন জানা যায়
তোমার সে স্বপ্নগুলো
নির্মমভাবে খুন হয়েছে
তখন আমি নিহত স্বপ্নের শোকে
চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মহাশূন্যে হারিয়ে গেলাম,
বহুকাল অন্ধকারের অনলে জ্বলে
কোনো এক মহাজাগতিক স্রোতে
নিজেকে আবার ফিরে পেলাম,
মেঘের মায়ায় রংধনুর রং মিশিয়ে
গোধূলীর রক্তিম বর্ণের মতো হাসলাম

ঠিক তখনই তোমার স্মৃতিগুলো ডানা মেলে
মায়াবি শিশুর মতো তাকায়
হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসে
অতঃপর আমাকে ছুঁয়ে ফেলে,
এভাবেই কোটি কোটি স্নায়ুকোষ
নিঃশব্দে আহত হয়

আর এখন তোমার স্বপ্নকে
একটু ছোঁয়ার অপেক্ষায়
আমি সময়ের বুকে
অনন্তকালের মতো ঘুমিয়ে পড়ি

ঘুমন্ত শহর

দূর থেকে ভেসে আসছে ধূসর আর্তনাদ
ক্রমশ পেরিয়ে যাচ্ছে নক্ষত্র থেকে ছায়াপথে;
যে আকাশজুড়ে স্বপ্নের বৃষ্টি ঝরে
সে আকাশ এখন দুঃস্বপ্নের।
এখানে নেই সেই সবুজ প্রান্তর
নেই কোনো স্নিগ্ধতা
অন্ধকারে মিশে গেছে মানবতা
দালানগুলো দানবের মতো মাথা তোলে
মানবিক মৃত্যুর কথা বলে,
পাখিরা গায় বিস্বাদের গান
সে গানের সুর ডানা মেলে দিকশূন্যপুর ।

এখানে অর্থের কাছে মানবতা হারে
মানবতার কাছে হারে না কিছুই,
মহামারির বিভৎসতা দুমড়ে মুচড়ে যায়
মানবতা চিরনিদ্রায় ঘুমায়
এ শহরের পথে পথে
মৃত্যুরা ব্যস্ত নানা আয়োজনে,
চারিদিকে অদৃশ্য আগুন
সে আগুনে সব পোড়ে
শুধু পোড়ে না অশুভ শক্তি।

নিঃস্ব মানুষের আর্তনাদে
এ শহরের বুকে বয়ে গেছে নীল সমুদ্র,
যে সমুদ্রে মিশে আছে
শত সহস্র চোখের লোনা জল;
সেখানে মানবতার কান্না
যেনো এক বহমান স্রোতধারা!

জীবনের কবিতা

চারিদিকে মৃত্যুর মিছিল
জীবন ঘুমায় অন্ধকারে,
এ কেমন মৃত্যুর জয়
দিকে দিকে জীবনের ক্ষয়!
জীবনের কানে মৃত্যুর তর্জন
গুমড়ে কাঁদছে ভবিষ্যৎ,
যুদ্ধে আহত বর্তমান
দিগন্তজুড়ে মৃত্যুর হাসি।
মৃত্যু কি জানে
জীবন মানেই মৃত্যুঞ্জয়ী!

একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু

বাংলার আকাশ, হিমেল বাতাস
বাংলার মেঠোপথ;
সবকিছু আজ অসহায় হয়ে
খোঁজে আলোর পথ।

বাংলার নদী, খাল-বিল যতো
বয়ে যায় বহমান;
এদের মাঝেই খুঁজি তোমায়
মুজিবুর রহমান।

নেই তুমি আজ আমাদের মাঝে
আছে ধুলোমাখা স্মৃতি,
তুমি বাঙালির জাতির জনক
অগাধ তোমার কৃতি।

ধূসর সেই স্মৃতিতে ডুবে
বাংলা আজো কাঁদে,
বাংলা সেদিন হেরেছে শুধু
নষ্টদের পাতা ফাঁদে।

মনে পড়ে যায় সেই কালো রাত
বর্বর হত্যাকাণ্ড,
বাংলার বুকে আঘাত হানে
বিশাল অগ্নিকাণ্ড।

শেখ কামাল, শেখ রাসেল
যায় নি কেউ বাদ;
এতো রক্ত ঝরিয়েও তাদের
মেটেনি মনের স্বাদ।

সেদিন কেঁদেছে বাংলার আকাশ
বৃষ্টির জল হয়ে,
নষ্টরা সব উল্লসিত
একাকার নেচে-গেয়ে।

নষ্টরা আজো মুখোশ পরে
ঘুরে বাংলার পথে,
নষ্ট সমাজ গড়তে তারা
থাকে অপচেষ্টাতে।

আজো বাংলার আকাশে-বাতাসে
শুনি মুজিবের ধ্বনি,
মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থেকে
দেখেন তিনি সবই।

নষ্টরা জানে মুজিব নেই
এই বাংলাদেশে,
লক্ষ মুজিব উঠছে গড়ে
বাংলাকে ভালোবেসে ।

বাংলার ফুল, বাঙলার ফল
যা কিছু আছে সজীব;
আমি দেখেছি সবকিছুতেই
চিরচেনা শেখ মুজিব ।

মুজিব তোমার হয়নি মৃত্যু
হয়েছে সারা বাংলার,
অমর হয়ে থাকবে তুমি
চোখের জলে সবার!