বই এবং একটি ধানের গন্ধ মোড়ানো ভোর ॥ শারমিন সুলতানা তন্বী


অলঙ্করণ: লংরিড

বলছি হেমন্তের হলুদ দিনের কথা। পাকা ধানের গন্ধে যখন গেরস্থের গোলার শরীর মন দুই-ই আহ্লাদী আবেশে আবেগঘন হয়, তখন আমি সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া কল্পনা বিভোর এক ঘাসফড়িং।শহর অভিমুখী জীবনের কটা দিন পেয়েছিলাম গ্রামের ভিন্ন আমেজে ভরা ধান কাটার মৌসুমে।আমাদের বাড়ির আঙিনাজুড়ে তখন কৃত্রিম চার দেয়াল তৈরি হতো স্তুপকৃত ধানে।ছাদহীন চার দেয়াল আজকের দিনের ড্রোনে করা চলচ্চিত্রে দারুণ আকর্ষণীয় হতো বোধ করছি যেখানে আকাশ আর জমিনের প্রেমে আকাশ ঝুঁকি জমিনের থুতনিতে চুমু খেয়ে যেত আক্লেশে। আমার হাতে তখন ‌‌‘হাত কাটা রবিন’ এর থ্রিলার।কল্পনা আর রোমান্টিকতায় আমি তখন খ্যারের পালায় দূর্গ আর ধানের শীষে ধারালো অস্ত্রের অগ্রভাগ দেখতাম।

বিদ্যুৎ আসেনি তখনো গ্রামে।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলে আমি হারিকেনের ক্ষীণ আলোয় নিজের অজান্তে রবিন হয়ে যেতাম।চেতন ফিরতেই হাতের অস্তিত্ব অনুভব করে বাধ্য মোমের মতো নিভে যেতাম। তারপর ভোরের আলো ফুটতেই ধানের গাদার পেছনে আমি আবার নিয়ে বসতাম হাত কাটা রবিন! আশেপাশের কিছু মানুষ আমার লুকিয়ে বই পড়ার দৃশ্য দেখে পরম মমতায় আমাকে পড়ুয়া ভেবে আজও ভুল করে।

আমি সেই রবিনকে ধারণ করেছি চেতনায়, অস্তিত্বে আর কর্মপরিকল্পনায়।তারপর বহুদিন গেল অবেলার ঘ্রাণ শুকে শুকে।হঠাৎ চোখ বাধা পড়ল নিমাই এর মেমসাহেব এরদিকে।আমি আমার সমস্ত অনুভূতির পাইকারি পশরা গুটিয়ে সম্পর্ক পাতালাম নিমাই এর সাথে। প্রাণ বুঝি যায় আহ্লাদী আবেশে, আমার দিবারাত্রি আপনার রঙ ভুলে এক রঙে মিলিয়ে আসতে লাগল। আমি যৌবনে হয়ে গেলাম মেমসাহেব নিজের অজান্তে।পড়ছি আর নিজেকে দেখছি মেমসাহেব রুপে।সংসার পেতে ফেলেছি মোটের উপর রাতের ট্রেন আর দিনের মাঝবয়সী রাস্তাটার সাথে।

আচমকায় ভরা সংসারে জল ঢেলে দিল বাজখাঁই কেউ একজন।পৃথিবীর সীমানা ছাড়ল মেমসাহেব, আর আমি আজও মেমসাহেব উপন্যাসের শেষ কটা পাতায় সীমানা পেরুতে পারিনি।

ধানের পাকা গন্ধের রেশ পেরিয়ে শহরের রোধ আর চিলেকোঠা আমায় দিতে পারেনি নতুন কোন আবেশ।অতৃপ্তি নিয়ে উড়ে গেছে বকপক্ষী জীবনের স্রোত ভালোবেসে।ভাটায় আটকানো আমি একদিন দেখি পরিণত মানানসই সাহিত্যের শিক্ষার্থী হয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি অথৈই জলে। পরীক্ষার নম্বরের খোঁজেই পৃষ্ঠা উল্টালাম বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসের।সময়ের গতিবেগ থেমে গেল পুরোনো গলিতে এসে।আবার ধানখেত, লুকিয়ে বইয়ের ভাঁজে আমি যেন হারিয়ে গেছি আপনার পৃথিবী থেকে।তারপর আমাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি নাগরিক জীবনের ইট বালি কাঠে।আমাকে খোঁজে বেড়ায় বৈকুণ্ঠের বিকেল একজোড়া কবিতা হাতে, লিখে যায় চিরকুটে ‘আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে’ আমাকে জায়গা মতো না পেয়ে।

আমার ভোরে এখনো রোদ উঠেনি অপরাহ্নের দিন মুড়িয়ে।এখনো সকাল আছে হেমন্তের হলুদ মায়া নিয়ে।