হিসেব করে দিন পার করতে কষ্ট হতো খুব, তখন মর্মান্তিক রাতের ভেতর আরেকটা রাত উপচে পড়তো চোখে। সে-চোখের ভিতরে আগুন লেপ্টে থাকা কাজল! জ্বলতে জ্বলতে রঙ ঢালতো বন্ধা আকাশ, আমার চৌকষ মেঘের ঘরে।গোটাকয়েক ঘামের ফোটায় ভিজতো অবসন্ন বাতাস।
এমনি করেই কেটে গেল সহস্র দিন।কাটতে কাটতে দিনগুলো সব পর হলো। যেদিন বিকেলে ভাসতে ভাসতে শুরু হলো ভাসিয়ে দেয়ার খেলা, সেইদিন শৈশব পুড়লো।ঘাসের কার্পেট মোড়ানো উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে ইচ্ছে হলো খুব।কিন্তু সেই উঠোন পেরিয়ে আমি তখন পেট্রোলের আগুনে দগ্ধ হচ্ছি জেলা শহরের রাস্তায়।দুই কিলোমিটার দূরে পদার্থ বিজ্ঞান রসায়ন পড়তে যেতে হতো মমতাজ উদ্দিন স্যার আর রাজেন্দ্র স্যারের বাড়ি।সকালে খালি পেটে বেরিয়ে যেতাম।কোনো কোনো দিন একটানা পড়ে, ক্লাস শেষ করে তবে ফিরতে হতো।নূরজাহান ফুফু ততক্ষণে গরম ভাত তরকারি রান্না করে বারান্দায় সাজিয়ে রেখেছে। আমার ক্ষুধা মরে যেতো অতো বেলায়, বিকাল অব্দি না খেয়ে থাকার জন্য।কিছু না খেলে নূরজাহান ফুফু মন খারাপ করে বসে থাকবে তাই না খেয়ে থাকার উপায় ছিল না।সে-ই ডুবন্ত সময় এত যুগ পর এমন স্থায়ী রঙে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি।
স্বপ্ন দেখি না আমি কখনও।সবকিছুই যেন ছেড়ে দিয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।ছেড়ে দিয়ে দেখি, কতদূর যেতে পারে সবাই। আমার তো মনে হয়, সময়কে পার করে বাড়ি ফিরতেই আধেক জীবন কেটে যায়।
যখন ফিরতে চাই পথে, জলে কিংবা জালে।বাড়িগুলো গাছ হয়ে ছাদের উপর অপেক্ষা করে।দেয়ালে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকে অবসন্ন বয়েসী কুকুর।
সময়ের কিনার নিংড়ে খেয়েছে আমাদের পরিচিত বাস্তব।যদিও জানি, বাস্তবতা সবসময় পরিচিত হয় না।অনেক অপরিচিত বাস্তব সত্য হয়ে ধরা দেয়, তাতেই কাটতে থাকে বাকিটা জীবন।
তুমি একদিন এ পথে এসো, যে পথ দিয়ে আসে-যায় আজান। যে পথে সেগুনের সারি। সন্ধ্যায় আজান আর শঙ্খের ভালোবাসা কাছাকাছি শব্দ করে ভাসে। যে পথে জলের উপর জল ডিঙানোর খেলা চলে সন্তর্পণে।
একদিন সেই পথে এসো।ঠিক আছে?
আমি অপেক্ষায় থাকি রোজ, ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত।
যখন মেখ ফুটে আলো ছড়াচ্ছে আকাশ ঠিক সেই সময় পাড়ায় পাড়ায় করুন বাতাস।হু হু করে কেঁদে উঠলো বেনুয়া বিধুর এলোমেলো সুর। আমি তো গান গাইতে শিখিনি কখনো, কি গাইবো বলো?
শরৎ মাথায় করে বয়ে বেড়াচ্ছে রোদ। তুমি ছুঁয়ে দিলেই দশদিক রোদ ঝলমলে সুর। তুমি ছুঁয়ে দিলেই সম্পূর্ণ শরৎ।মেঘলা রঙের আঁচল আর নীল পাঞ্জাবি ঘিরে থাকতো গাঁ।গাঙের ধারে চুপচাপ সন্ধ্যা নামে।
অপেক্ষা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কালো হয়ে যায় আলো।বাতাসের মতো কে যেনো দৌড়ে আসে।চলে যায়।আঁচড় কেটে বয়ে যাচ্ছে স্রোত।একটু ছুঁয়ে গেলে কী এমন ক্ষতি হতো? প্রশ্ন জাগে, চলে যাওয়া আর বয়ে যাওয়া কি এক? শুধাই কাকে, কে দেবে উত্তর…?