গত এপ্রিলের শুরুর দিনটায় আমার জন্মদিনে অজস্র মানুষ আমাকে উইস করেছেন। অনেকেই পাঠিয়েছেন বার্থ ডে গিফট। গিফট এর তালিকায় ছিলো বর্ণাঢ্য ভার্চুয়াল ফুল, সুদৃশ্য কেক ইত্যাদি। কয়েকজন বন্ধু পাঠিয়েছেন অনন্য ব্যতিক্রমী গিফট–আমার পোর্ট্রেট বা ক্যারিকেচার বা কার্টুন।এদের একজন তন্ময়।সৈয়দ রাশেদ ইমাম তন্ময়।হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত তরুণশিল্পী তন্ময় আমাদের দেশের এক উজ্জ্বল মেধাবী আঁকিয়ে।পত্রিকার পাতায় এবং কমিক সিরিজে প্রকাশিত তন্ময়ের আঁকা ছবি দর্শক-পাঠকের আদর ও ভালোবাসা কুড়িয়েছে বিপুল। ওর সবচে উল্লেখযোগ্য কাজের নমুনা হচ্ছে গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’।বঙ্গবন্ধুর জীবনীভিত্তিক কমিক সিরিজ।
আমার জন্মদিনে দুটো ছবি পাঠিয়েছিলো তন্ময় যার একটিতে সে আমাকে এঁকেছে একটি কাঠঠোকরার আদলে।কোনো একজন মানুষের বিশাল একটা কানের লতিতে ঝুলে আছি কাঠঠোকরারূপী আমি।অদৃশ্য সেই মানুষটার কানের মধ্যে ফ্রি হ্যান্ড লেটারিং-এ মোটা হরফে রিভার্সে উৎকীর্ণ তিনটিমাত্র শব্দ–ঠক ঠক ঠক।
ইনবক্সে পাঠানো ছবিটার নিচে তন্ময় লিখেছে–‘ছড়ার ছন্দে সবার কান ঠুকরে যান আজীবন!’
সত্যি বলতে কি-চমকে উঠেছি আমি তন্ময়ের গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতায়।লেখক এবং শিল্পীদের থাকতে হয় প্রবল অবজারভেশন পাওয়ার।তন্ময়ের মধ্যে সেটা প্রত্যক্ষ করে আমি উল্লসিত।কারণ গত প্রায় পঞ্চাশটি বছর ধরে আমি এই কাঠঠোকরাটির মতো ঠোকাঠুকির কাজটাই তো করতে চেয়েছি বা করে যাচ্ছি বিরামহীন! প্রীতিভাজন তন্ময় সেটা ঠিক ঠিক অনুধাবন করতে পেরেছে।
বাংলাদেশের শিশু কিশোরদের অনিন্দ্যসুন্দর ভুবনের একজন বাসিন্দা হিসেবে প্রধানত আমার টার্গেট অডিয়েন্স ছোটোরা।ছোটদের জগৎ এমনিতেই বর্ণালি।রঙ ঝলোমল।ফ্যান্টাসি আর আনন্দে ভরপুর।সেই ফ্যান্টাসি আর আনন্দে সামান্য বাড়তি কিছু রঙ আমি যুক্ত করতে চেয়েছি গোটা জীবনভর।ছন্দে ছন্দে রাঙিয়ে দিতে চেয়েছি ওদের জীবনের কিছু মুহূর্তকে।
মূলত ছোটদের জন্যে লিখলেও যেহেতু আমি একজন সামাজিক মানুষ, যেহেতু আমি বাঙলা বাঙালি বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী একজন নাগরিক, সেইহেতু আমাকে কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক নাগরিক দায়ও মেটাতে হয়।সেই কারণে
দেশ ও দেশের মানুষের যেকোনো দুর্যোগে দুঃসময়ে ক্রান্তিকালে কিংবা অর্জনে ও প্রাপ্তিতে, আনন্দে ও বেদনায়, ছড়াকার হিসেবে আমার একটা ভূমিকা থাকেই।সেই ভূমিকাটি পালন করতে গিয়ে আমাকে লিখতে হয় অজস্র ছড়া–যা বড়দের পাঠোপযোগী বা বয়স্কজন পাঠ্য।
আমার এরকম ঠোকাঠুকিতে বাংলাদেশের কুখ্যাত বা বিখ্যাত বহু গণধিকৃত চরিত্র আহত হন বিরক্ত হন উত্তেজিত হন।গণমানুষের মনের কথাটিই বলতে হয় লেখক শিল্পীকে।একজন লেখক কিংবা একজন শিল্পীর বলা কথাটিই তখন সমষ্টির কথা হিসেবে বিবেচিত হয়।
স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনসমূহ, স্বৈরশাসন সামরিক শাসন অপশাসন দুঃশাসন ও সমসাময়িক বিষয়ের নানা খণ্ডচিত্র তাই চিত্রিত হয়ে আছে আমার বড়দের জন্যে রচিত ছড়ার বইগুলোয়।সংখ্যার হিসেবেও যা কম নয়।অনিন্দ্যপ্রকাশ সেই বইগুলো এক মলাটে নিয়ে এসেছে ২০১৫ সালে।যার নাম রেখেছি আমি–‘এডাল্ট ছড়াসমস্ত’। কোনো রকম ইলাস্ট্রেশন ছাড়া প্রতিটি ছড়া হাফ ইঞ্চি স্পেস ব্যবধান মেনে টানা মেকআপে পাতা সাজিয়েছি।তারপরেও বইটি দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচশো পৃষ্ঠায়।
২০১৫-এর পরে লেখা বড়দের ছড়াগুলো নিয়ে প্রকাশের অপেক্ষায় আরো দুতিনটে বই।এখন কথা উঠতে পারে এতো ছড়া আমি লিখি কেনো? কেনোই বা আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা একশোরও বেশি।এর উত্তর একটাই।
ছড়া লেখার বাইরে আর কিছু পারি না আমি।
খুব কম যোগ্যতা নিয়ে আমি পৃথিবীতে এসেছি।এসেছি খুব কম আয়ু নিয়েও।
মানুষের চেয়ে অনেক অনেক বেশি বাঁচে একটি কচ্ছপ।
আমার ক্ষমতা আর যোগ্যতা বিষয়ে আমি সচেতন।
আমি জানি আমার চাইতে অনেক বেশি ক্ষমতা রাখে এমনকি একটি কাঠঠোকরাও।
আমি জানি একটি কাঠঠোকরা সেকেন্ডে কুড়িবার ঠোকরাতে পারে।
কিন্তু আমি তো পারি না এতো!
একটি কাঠঠোকরার ক্ষিপ্রতার তুলনাতেও আমি নিতান্তই হাস্যকর পর্যায়ের!
কারণ একটি কাঠঠোকরার ঠোকরানোর গতি (ঘাড় ওঠানো নামানো) ১২০০ থেকে ১৫০০ জি ফোর্স অর্থাৎ কিনা গ্রাভিটেশনাল ফোর্স।
সেখানে মানুষের ক্ষেত্রে তার হিসেবটা সর্বোচ্চ ৬০ থেকে ১০০ জি ফোর্স মাত্র!
গাছের জন্য ক্ষতিকর পোকাগুলো খেয়ে একটি কাঠঠোকরা
নিসর্গে গাছ টিকিয়ে রাখতে যে ভূমিকা সে রাখে আমি তো সেই তুলনাতেও অতি অতিনগন্য পর্যায়ের!
মানুষের জন্যে ক্ষতিকর, সমাজের জন্যে ক্ষতিকর এবং দেশের জন্যে ক্ষতিকর প্রাণিগুলোকে তো আমি নিশ্চিহ্ন করতে পারি না কাঠঠোকরাদের মতো!
তারপরেও আমার অতিনগন্য ক্ষমতা দিয়ে সভ্যতাবিনাশী ক্ষতিকর প্রাণিদের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করতে সাধারণ মানুষের কান আমি ঠুকরে যাবো–
ঠক ঠক…
ঠক ঠক…
ঠক ঠক…
অটোয়া ২৮ জুন ২০২২
[কার্টুন/ তন্ময়]