নবম পর্ব
নজরুলের যত্ন-আত্তির ব্যাপারে বিরজা দেবী খুবই সতর্ক। নজরুলের কোনো রকম অবহেলা যাতে না হয়; তার খাওয়া দাওয়ায় যাতে কোনো ত্রুটি না হয় সেজন্য তিনি নিজেই তদারকি করেন। সব সময় নজর রাখেন। কখনো কখনো নিজেই খাওয়াতে বসান। এটা ওটা পাতে তুলে দেন। কাজের ব্যস্ততার কারণে তিনি সব সময় দেখতে পারেন না। তাই নজরুলের দিকে লক্ষ রাখার জন্য দুলিকেও বলে দেন। শোন দুলি, আমি যেন কখনো শুনতে না পাই যে, নজরুলের ঠিকমতো খাওয়া হয়নি। অথবা কিছু চেয়ে পায়নি। যখন যা দরকার তুই আমাকে বলবি।
আশালতা ঘাড় নেড়ে বিরজা দেবীর কথায় সায় দেয়। মনে মনে সে বলে, আমি তো আপনার এই নির্দেশের অপেক্ষাই করছিলাম কাকীমা। আমি নিজেও তো আমার প্রাণের মানুষের কাছাকাছিই থাকতে চাই। তাকে নয়নভরে দেখতে চাই।
আশালতাকে চুপ থাকতে দেখে বিরজা দেবী বললেন, কি রে দুলি; চুপ করে আছিস যে! কিছু বল!
জি কাকীমা। আপনি নিশ্চিত থাকেন। আমি সব সময় খেয়াল রাখব।
বিরজা দেবী নজরুলের ঘরে ছুটে যান। তাকে উদ্দেশ করে বলেন, তুমি আমার ছেলে। এই বাড়িটা নিজের মনে করবে। যখন যা লাগে, বলবে। কোনো রকম লজ্জা করবে না। লজ্জা করলে বুঝব তুমি আমাকে মা ডাকলেও মন থেকে মা হিসেবে গ্রহণ করোনি।
কী যে বলেন মা! আমি আমার মায়ের ভালোবাসা পাইনি। আপনার ভালোবাসা পেয়েছি।
তাহলে মন দিয়ে শোন, এটা তোমার নিজের বাড়ি। আমার বীরেন্দ্রের যে অধিকার, তোমারও সেই অধিকার। আমি দুলিকেও বলেছি; ও যেন সব সময় তোমার দিকে খেয়াল রাখে।
নজরুল বিনয়ের সঙ্গে বললেন, আমি তো বেশ আছি মা! তারপরও আপনি এতো চিন্তা করছেন কেন?
বাবা, তুমি তো দেখছই, সংসারের সব ঝামেলা আমার ওপর। সব সময় সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তোমার দিকে তেমন নজর রাখতে পারি না। কখন কি দরকার বুঝতেও পারি না।
মা, এরপরও আপনি বলছেন কী লাগবে বুঝতে পারেন না! আমার কী লাগবে সেটা বুঝে ওঠার আগেই তো আমার হাতে সামনে সবকিছু চলে আসে! এতো কিছু সামলানোর পরেও আপনি যে আমার সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নেন; এটা যে আমার পরম পাওয়া! এতোটা আমি কখনো আশা করিনি।
পুত্রতুল্য ছেলের সঙ্গেও বিরজা দেবীর বিনয়ের শেষ নেই। তিনি বিনয়ের সঙ্গেই বললেন, এ কী বলছ বাবা! পরম পাওয়া কেন হবে? এ তো মায়ের কাছে ছেলের অধিকার!
বিজরা দেবীর কথায় নজরুল আবেগাপ্লুত হয়ে যান। তিনি আবেগের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। মনে মনে বলেন, এই মহীয়সী নারীর ঋণ আমি কী করে শোধ দেবো!
নজরুল কিছু বলার আগেই বিরজা দেবী বললেন, তোমার পকেট তো মনে হচ্ছে খালি।
না না! আছে। টাকা-পয়সা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আপনি এতো কিছু করছেন! এরপর টাকা-পয়সা নিয়েও..
এই যে! আচ্ছা, তুমি তোমার মাকে এ কথা বলতে পারতে? পারতে না। তার মানে তুমি আমাকে সত্যিকারের মায়ের আসনে বসাতে পারোনি।
আমি দুঃখিত মা। আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি ওভাবে বলতে চাইনি। আসলে আমি ছোটবেলা মায়ের আদর-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। মায়ের আদর-ভালোবাসা কাকে বলে তা জানিও না। আপনার কাছ থেকে যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি তা কোনোদিন ভুলতে পারব না।
বিরজা দেবী আঁচলের গিট থেকে টাকা বের করে নজরুলের সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই ধরো, টাকাটা রাখো। পুরুষ মানুষের পকেটে টাকা না থাকলে কি গায়ে জোর থাকে!
নজরুল বিরজা দেবীর টাকা ফিরিয়ে দিতে পারলেন না। তিনি কৃতজ্ঞতার ভঙ্গিতে বললেন, মা আপনাকে যতই দেখছি ততই বিস্মিত হচ্ছি। পৃথিবীতে এমন মা আর হয় না!
বিরজা দেবী নজরুলের মুখে হাত চেপে ধরে বললেন, বড্ড বেশি কথা বলো। এরপর যদি তুমি আমার কাছে টাকা পয়সা না চাও তাহলে কিন্তু আমি রাগ করব।
নজরুল আর কোনো কথা বলার সুযোগ পেলেন না। তিনি কিছু বলার আগেই বিরজা দেবী চলে গেলেন। তার পেছনে পেছনে এগিয়ে যায় আশালতা। নজরুল উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ পর আশালতা আবার নজরুলের কাছে ফিরে আসে। নজরুল তখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি। তিনি ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে আশালতার দিকে তাকান। তাকে নীরব থাকতে দেখে আশালতা বলে, কী ব্যাপার! একেবারে নীরব হয়ে গেলেন!
মা’র কথা ভাবছি।
কাকীমা সত্যিই অসাধারণ!
তুমি চিন্তা করে দেখ, সবদিকে তার নজর। আমি সত্যিই অবাক হচ্ছি। একটা মানুষ কী করে এতোকিছু খেয়াল রাখতে পারেন!
আমিও এমনটি দেখিনি। আমার মা’র সঙ্গেও কাকীমার তুলনা চলে না। আচ্ছা শোনেন, আপনি না বাইরে যেতে চেয়েছিলেন! এখন যাবেন?
তুমি যাবে?
যাবো।
সত্যিই!
সত্যি তো। আমি কাকীমাকে বলে এসেছি।
বলো কী!
হ্যাঁ।
তিনি কি বললেন?
যেতে বললেন।
বাহ!
আশালতা মুচকি হাসে। নজরুল তার হাসির জবাব দেয়। তারপর তারা বাইরে বের হয়। হাঁটতে হাঁটতে দীঘির পাড় পর্যন্ত চলে যায়। দীঘির পাড়ে তারা বসে। এই প্রথম তারা নিরিবিলি পরিবেশে একটু বসার সুযোগ পেল। সুযোগ পেল একটু মন খুলে কথা বলার। একে অপরকে ভালোলাগার কথা; ভালোবাসার কথা।
(চলবে)