নিষ্প্রভার রঙ ফিরে পাওয়া (পর্ব-১) ॥ ইসরাত জাহান


চিত্রশিল্পী: কাজী জহিরুল ইসলাম

নিষ্প্রভার রঙ ফিরে পাওয়া
কফির মগে লাস্ট চুমুকটা দিয়ে সবকিছু গুছিয়ে যখনই অফিস থেকে বের হবে, তখনই শারমীনের ডাক পড়ে বসের রুমে।ঘন দুধ আর ফেনাযুক্ত উষ্ণ ক্যাপাচিনোর তৃপ্তি নিমেষে হাওয়া হয়ে যায় ষাটোর্ধ জাদরেল বসের ডাকে।তিতিবিরক্ত মেজাজের সাথে প্লাস্টিক হাসির সমন্বয় ঘটিয়ে শারমীন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও।বস এক সপ্তাহের বিদেশ ভ্রমণ শেষে আজই অফিসে ফিরেছে।তাই অফিস মোটামুটি তটস্থ তার উপস্থিতে।

যাবার আগে শারমীনকে দুটো প্রজেক্টের কাজ দিয়ে গিয়েছিলো।এখন সেগুলোর লাস্ট আপডেট জানতে চাইবে।ওদিকে আজ ওকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।মায়ের তাড়া।এখন যদি দুই প্রজেক্টের ফাইল নিয়ে বসে তাহলে কম করে হলেও সাড়ে নয়টা বেজে যাবে।

‘আজ না স্যার কাল বসি, বাসায় গেস্ট আসবে’-এই কথা অনেকক্ষণ মনে মনে আওড়ায় বলার জন্য কিন্তু সেটা কিভাবে স্যারকে বলবে তাই ভেবে পায় না শারমীন।ওদিকে আজ তাড়াতাড়ি না ফিরলে মা ভীষণ রেগে যাবে।বের হবার সময় পইপই করে ওকে বলেছিলো,
‘ছুটি নাও,আজ কোনভাবেই দেরি করা চলবে না’

কাঁচের দরজা সরিয়ে শারমীন যখন বসের সামনে গিয়ে হাজির হয়, তখন আকমল সাহেব অনেকগুলো ফাইলের ভিতরে চোখ ডুবিয়ে বসে আছে।
স্যার ডেকেছিলেন?
চশমার ফাঁকে, কপাল কুঁচকে শারমীনের দিকে তাকায় আকমল সাহেব অনেকটা অপরিচিত চাহনিতে।
জি, ডেকেছিলাম।আমাদের উত্তরার ছয় নম্বর সেক্টরের প্রজেক্টটা নিয়ে বসুন।ওটার লাস্ট আপডেট কি?
স্যার, একটা কথা ছিলো।
কি ব্যাপারে?
স্যার আজ আমার একটু তাড়া আছে, আগামীকাল বসলে কি, (কথাটা শেষ করতে পারে না, তার আগেই বস কথা শুরু করে)
এনি প্রব্লেম? আমি তো আগামীকাল ফার্স্ট ফ্লাইটে ইউকে যাচ্ছি।আজ না বসলে একটু প্রব্লেম হবে মনে হয় আপনার।অল্প কিছু বাক্য ব্যয়ে নিজের অপারগতার কথা জানিয়ে, আবারও চোখ ডোবায় ফাইলের কালো অক্ষরের মাঝে।

শারমীন পেশায় একজন আর্কিটেক্ট।পাঁচ বছর যাবত দেশের একটি নামকরা রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে কাজ করছে।এই পাঁচ বছর কাজের সুবাদে ওর বস আকমল সাহেবের কাছে কিছুটা নির্ভরতা অর্জন করতে পেরেছে।তাই তো বিদেশে যাবার আগে উত্তরার বড় দুটো প্রজেক্টের কাজ ওকে দিয়ে যায়।শারমীন এর মধ্যেই ক্লাইন্ডের সাথে দুইবার মিটিং করে বিল্ডিংয়ের নকশা, তাদের আইডিয়া, স্কেচ, পুরো প্রজেক্টের ব্যয় সবকিছু নিয়ে মোটামুটি আলোচনা করে ফেলেছে।বিভিন্ন সময় সেগুলো বসকে ইনফর্ম ও করেছে।এই মুহূর্তে আকমল সাহেব সেগুলোই নিজের চোখে চেক করে পরবর্তী কাজগুলো দেখিয়ে দেওয়ার জন্য এই মিটিংয়ে আয়োজন করে।কিন্তু আজকের সময় একটু অসময় হয়ে যায় শারমীনের জন্য।আজ শারমীনের জীবনে বিশেষ একটি দিন হলেও হতে পারে।

অনেকটা তাড়াহুড়ো করে রাত নয়টায় শারমীন মিটিংয়ের রুম থেকে বের হয় দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বসকে বকাবকি করতে করতে। উবারে কল করে, কিন্তু কাছে পিঠে কোন গাড়ির সন্ধান দিতে ব্যর্থ হয় উবার নামক অ্যাপ ভিত্তিক ট্যাক্সি সেবার প্রদানকারি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠানটি।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শারমীন পায়ের সার্ভিসের ওপর নির্ভর করে হাঁটা শুরু করে।বনানী ১২ থেকে আজিমপুরের দুরত্ব এতটাই বেশি যে পায়ের উপরে নির্ভর করতে পারে না শারমীন।আশপাশে তাকায় সিএনজি আশায়।

হঠাৎ শারমীনের মনে হয়, একটি কালো রঙের গাড়ি ওকে ফলো করছে।মুহূর্তেই পা দুটো আসাড় হয়ে আসে, এক বিন্দু হাঁটার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলে নার্ভের অসহযোগিতায়।গাড়িটা হালকা ব্রেক কষে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়, ধীরে ধীরে গাড়ির কালো গ্লাসটা নিচে নেমে আসে।

ম্যাডাম, লিফট লাগবে?
জি, না।
আমরা আজিমপুরের দিকেই যাবো।
আমি ওদিকে যাব না।আপনি আসুন,বিরক্ত করলে লোক জড়ো করবো কিন্তু।
ঠিক আছে, ম্যাডাম।

গাড়িটা কিছু দুর গিয়ে দাঁড়ায়, একটু পরে ব্যাক গিয়ারে দিয়ে আবারও ওর সামনে এসে দাঁড়ায়।এবারে গাড়ির পেছনের গ্লাসটা নেমে যায়। গ্লাসটা নেমে যাওয়ার সাথে সাথে ওর চোখ আর কপালের আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়।সেই পরিবর্তনটা দেখে গাড়ির ভেতরের অবস্থানকারী ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বলে ওঠে।
নাকটা তো এখনও ফুলে উঠলো না রে..
এই মাঝরাতে তুই কোথা থেকে?
তুই সেখান থেকে আমিও সেখান থেকে।
মানে, তুই কি এখন দেশে নাকি?
সবকথা রাস্তায় দাঁড়িয়ে শেষ করবি, গাড়িতে উঠে আয়।

ড্রাইভার তাড়াতাড়ি বের হয়ে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দেয়। শারমীন গাড়িতে উঠে বসে।সাজ্জাদ আবারও সেই হাসিটা উপহার দেয় শারমীনকে।
এতো হাসির কি হলো শুনি, তখন থেকে হাঁদারামের মতো হেসেই চলছিস।
তোকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইউনিভার্সিটির কথা মনে পড়ে গেলো।

ইউনিভার্সিটির কথা বলতেই শারমীন চুপ হয়ে যায়।শারমীনের নিরবতা ওকেও কিছুক্ষণের জন্য নিরব করে দেয়।কিন্তু চিরকালের চঞ্চল সাজ্জাদ কিছু সময় পরে আবারও আলাপ শুরু করে।
আজ এত দেরি হলো তোর?
কাজ ছিলো।তুই এখনে কিভাবে? তুই কি এখন দেশে থাকিস? কবে আসলি ইংল্যান্ড থেকে?
একটা একটা করে উত্তর দেই, আমি এখানে এসেছিলাম একজনকে একটা কথা বলতে, দেশে থাকার ইচ্ছে আছে, একমাস হলো দেশে এসেছি।
আজ আমার দেরি হলো মানে? তুই কিভাবে জানিস, আমার কখন ছুটি হয়।
তুই বলেছিলি তোর অফিসের কথা, মনে আছে?
শারমীন একটুভাবে, মনে করার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না।কারণ ওর মনে পড়ে, ও কখন সাজ্জাদের সাথে যেচে কোন কথা বলেনি সেইদিনের পর থেকে, তারপর থেকে তো যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ।তারপর নিজের থেকেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে শারমীন বলে ওঠে।
তন্নীর বিয়েতে গিয়েছিলি?
গিয়েছিলাম, তুইতো আসলি না।আমি তোর অপেক্ষায় ছিলাম সেইদিন।

দ্রুত গতি গাড়িটাকে হঠাৎ করেই শারমীনের মনে হয় ওটার গতি জড়তার অবনতি হয়েছে।আর সেই কারণে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে।নিজেকে সামলিয়ে নেয় বেশ ত্বরিতার সাথে।

অপেক্ষা… কথাটা ওর বুকের বাঁপাশের হৃদয়ের মিউজিকটাকে দ্রুত তালে কুচকাওয়াজ শুরু করিয়ে দেয়।যার ওর শরীরে ভালোলাগা,ঘৃণা,কান্নার কাঁপন সৃষ্টি করে।

সাজ্জাদ ওর জন্য অপেক্ষা করেছিলো সেইদিন, কিন্তু কেন? ওর তো অপেক্ষা করার কথা নয়।একটা সময় এই অপেক্ষাটা… শুধুমাত্র শারমীন করতো।ক্যাফেটোরিয়ায়, লাইব্রেরি, ক্লাসের বাইরে, ক্লাসের ভেতরে, সারাক্ষণ সাজ্জাদের জন্য অপেক্ষা।কখন আসবে, একটু দেখবে।

সাজ্জাদ আর শারমীন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছিলো একসাথে। একই বন্ধুমহল, উঠাবসা সব একসাথেই ছিলে ওদের।সাজ্জাদ ছিলো ওদের ক্লাসের সবচেয়ে সুদর্শন ছেলে।নিউ সেশন এলে নিউ পার্টনার জোগাড় করা ছিলো ওর রোজকার রুটিনের মতো ব্যাপার।আর শারমীন সাধারণ চেহারার মোটামুটি ভালো টাইপ স্টুডেন্ট।পড়াশোনা ছাড়া অন্য আর কোনদিকে কোন নজর ছিলোনা।হঠাৎ করে শারমীন কোন কারণ ছাড়াই সাজ্জাদের প্রেমে পড়ে যায় থার্ড ইয়ারে পড়ার সময়।কিছুদিন সেই কথা নিজের ভেতরে চেপে রাখে, লাস্ট ইয়ারে একদিন সাহস করে একটা চিঠি লেখে সাজ্জাদের কাছে।তবে ওটার প্রতি উত্তরটা যে এতো জঘন্য ভাবে আসবে সেটা শারমীন কখনো কল্পনাও করতে পারেনি, সেই সময়…

একদিন সবাইকে ডেকে, ইউনিভার্সিটির ক্যাফেটোরিয়ায় সবার সামনে সাজ্জাদ সেই চিঠি পড়ে শোনায় প্রেরকের নামসহ।সেই চিঠি নিয়ে নানারকম ব্যঙ্গ, আরও কতশত ঢঙ।কিভাবে আরও রোমান্টিক প্রেমপত্র লেখা যায় তার উপরেও ছোটখাটো ক্লাস নেয় সবার।সেদিনের পর থেকে রাগে, ঘৃণা, অভিমানে, লজ্জায় শারমীন ক্লাসে যাওয়া,পড়াশোনা একেবারে বন্ধ করে দেয়।প্রতিজ্ঞা করে সাজ্জাদ নামক ভালোলাগাকে পুরোপুরি মন থেকে মুছে ফেলবে, কখনো মুখ দেখবে না।সেই কারণেই টার্ম ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণও করে না।সাজ্জাদকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে নিজেকে নিজেই পিছিয়ে নেয় এক বছরের জন্য।

কি রে চুপ হয়ে গেলি একেবারে?
কোথায়? তুই কথা বলছিস তাই।
কেন অপেক্ষা করে ছিলাম, জানতে চাইলি না যে?
না বললে জানবো কিভাবে?
শারমীন আই এম স্যরি?
কেন? কি করেছিস তুই?
তোকে ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’ হবার সন্মান না দেবার জন্য।সবার সামনে তোকে ছোট করার জন্য…
থাক,ওগুলো পুরনো কথা, ভুলে যা। যা গেছে পুরোপুরিই গেছে,তাছাড়া ওটা আমার বোকামি ছিলো।অন্যকিছু নয়।
কিন্তু…
সাজ্জাদকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে শারমীন।
কতদূর এলাম ড্রাইভার সাহেব?
সাইন্সল্যাব।
আমাকে নীলক্ষেতের মোড়টায় নামিয়ে দেবেন, কেমন।
দুজনেই চুপ হয়ে যায়, ওদের সঞ্জীবনী কাব্য আবার তার লয়, মাত্রা ও তালের ছন্দপতন ঘটায়।কোনভাবেই সেটা শুদ্ধ সংগীত হয়ে উঠতে পারে না।শারমীন নেমে যায় ওর নির্দিষ্ট স্থানে শুধু ধন্যবাদটুকু বলে।

রাত যখন সাড়ে দশটা। শারমীন বাসায় ঢোকে ধীর পায়ে। ঢোকার মুখেই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায় কিছু অপরিচিত মানুষের বসার ঘরে উপস্থিতর কারণে।
এই তো শারমীন এসে পড়েছে।এত দেরি হলো আজ।
এই কথা বলতে বলতে শারমীনের মা চোখের ইশারায় মুরব্বিদের সালাম করতে বলে মেয়েকে।সাজ্জাদের ঘোর পুরোপুরি না কাটার কারণে একটু দেরি হয়ে যায় মায়ের ইশারা বুঝতে।কোনমতে সালাম দিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে অনেকটা চোরের মতো।পিছন থেকে মায়ের হুংকারে অনেকটা লাফিয়ে উঠে শারমীন।
তাড়াতাড়ি একটু ফ্রেশ হয়ে সামনের রুমে আসো।ওরা অনেকক্ষণ হলো বসে আছে।আর ফোন ধরছিলে না কেন?
ফোন মিউট করা ছিলো, তুমি যাও, আমি আসছি।

মনের সকল দ্বিধা দূর করে নিজেকে সাজ্জাদের চৌম্বক আকর্ষণ থেকে বের করে নেওয়ার জন্য শারমীন নিজেকে তৈরি করে।যতটুকুতে নিজেকে সুন্দর লাগবে সেটুকুই সাজে।ধীর পায়ে এগিয়ে যায় বসার ঘরে সেই মানুষগুলোর সামনে।সালাম দিয়ে চোখ তুলে তাকাতেই চোখ পড়ে কর্নারে বসে থাকা ছেলেটির উপর।
সাজ্জাদ…?

চলবে