মায়াবন বিহারিণী (পর্ব-৩) ॥ আরিফুর রহমান


একদিন শহরের উপকণ্ঠে যেখানে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট রয়েছে সেখানে বেড়াতে গিয়েছিল মনা।ওর সাথে ছিল পলি ও ঝুমা নামের আরও দুজন বন্ধু।

একপাশে নানান ধরনের ফসলের বিশাল মাঠ আর অন্যপাশে ফলদ ও বনজ গাছের সমারোহ দেখতে দেখতে মাঝখানের পথটা ধরে ওরা হেঁটে হেঁটে চলে গেছিল বহুদূর অব্দি।মোবাইলের ক্যামেরায় ছবি তোলা হচ্ছিল অবিরত।

ইটের রাস্তাটা শেষ হলে একসময় ওরা মেঠোপথ ধরে এগিয়ে গেছে আরও সামনে।পলিকে খুবই উৎফুল্ল দেখাচ্ছে।বহুদিন পর সে এমন অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছে।আসলে ওর চলাফেরা একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতর সীমাবদ্ধ।এসএসসির পরপরই একটা রক্ষণশীল পরিবারে ওর বিয়ে হয়ে যায়।ফলে ম্যাচিউরড্ লাইফের স্বাধীনতার স্বাদ সে আজই প্রথম পেল!
ঝুমা অবশ্য বরাবরই পাখির ডানা পাওয়া মেয়ে।ওর গানের গলাও খুব ভালো।সে গলা ছেড়ে গাইছে, কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে, মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা, মনে মনে।

আর মনা-ও বেশকিছু দিন ধরে শহরের যান্ত্রিক পরিবেশে চলতে চলতে যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল।তাইতো ঝুমা বেড়াতে বেরোনোর প্রস্তাব দিতেই ও রাজি হয়ে গেছিল।পলি-টা সিদ্ধান্ত নিতে পাচ্ছিল না, কারণ কোনোভাবে ওর বাসায় খবরটা পৌঁছালে সর্বনাশ! ঝুমা ওকে সাহস দিয়েছে, দেখ, আমরা খুব বেশিদূর যাচ্ছি না।সন্ধ্যার আগেই ফিরেও আসব।আর ওদিকটায় তোদের বাড়ির বা তোর শ্বশুর বাড়ির কেউ যাবে এমনটা কেবল দুঃস্বপ্নেই সম্ভব।তাছাড়া তুই তো বোরকা পরেছিস, দেখলেও কেউ তোকে চিনতে পারবে না।সো, লেটস গো।

সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে ঝুমা-র বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে পলি বলেছিল, চল, আল্লাহ ভরসা।
মনা যোগ দিয়েছিল পথে।ওর শুধু ছবি আঁকবার নয় ছবি তোলবার হাতও চমৎকার!সেদিনের প্রায় সব ছবিই ওর তোলা।
সেদিন ঝুমা-কে গাইতে শুনে মনা-ও গেয়েছিল, এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলতো?
ওর গান শুনে পলি খলবলিয়ে বলে উঠেছিল, থাক সে আর কিছু না বলুক! দেখ, মেঠোপথটা তোর গান শুনে সত্যি সত্যিই শেষ হয়ে গেল!
ওরা তিনজন একসাথে প্রাণখুলে হেসে উঠলে চমকে উঠেছিল ফসলহীন ন্যাড়া মাঠে ক্রিকেট খেলায় মেতে থাকা একদল ছেলে!

হাসতে হাসতে ঝুমা মনা-র বাহু চেপে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, এই সে-টা কে রে? বল বল বল না!
পলিও বলেছিল, বল বল বল না!
ওদের ভেঙচিয়ে একজন খেলোয়াড় বলেছিল, বল বল এই বল দে! চল চল খেলি, চল খেলি।
বাকিরা হেসে উঠেছিল কলকলিয়ে!
মনা ও পলি খুব লজ্জা পেয়েছিল, কিন্তু রেগে গেছিল ঝুমা।ও আগুন চোখে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ।মনা ও পলি শান্ত করেছিল ওকে।ফিসফিস করে বলেছিল, চল, আমরা চলে যাই।মনে হচ্ছে না এরা সবাই ভালো ছেলে।

ঠিক বলেছিস।একেকটার চেহারা দেখ না, মনে হয় নেশাটেশা করে।বাদ দে, চল ফিরে যাই।
মনে মনে ছেলেগুলোর চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে ফিরতি পথ ধরেছিল ওরা।টের পায়নি, আলপথে বসে খেলা দেখাদের তিনজন সন্তর্পণে তাদের পিছু নিয়েছে।

ওরা বড়োরাস্তায় পৌঁছে দেখল পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া সূর্যটা লাল হতে শুরু করেছে।রাস্তার উল্টোদিকে হর্টিকালচার সেন্টার।ভেতরে ফুলের বাগান, বড়ো বড়ো পুকুর, পুকুরের পাড়ে নারকেল ও সুপারি গাছের সারি, বিশাল আমবাগান।সবগুলো গাছের গোড়া থেকে কাণ্ডের দিকে আড়াই ফুট পর্যন্ত রং করা।পাঁচিলের বাইরে রেললাইন।সবমিলিয়ে শুটিং স্পটের মতো ব্যাপার স্যাপার। পলি আর ঝুমা অনেকবার ট্রেন থেকে ভেতরের কিছু অংশ দেখেছে, কিন্তু সরাসরি ভেতরে যায়নি কোনোদিন। আর মনা একেবারেই দেখেনি।ফলে তিনজনেরই ইচ্ছে হলো ভেতরটা ঘুরে দেখবার।ঝুমা জানে ওখানে ঢুকতে হলে কর্মকর্তাদের কারোর অনুমতি নিতে হয়।কিন্তু ওরা তো কাউকে চেনে না।চাইলেই অনুমতি পাওয়া যাবে?

মনা বলল, থাক, আজ আর গিয়ে কাজ নেই।বিকেলটাও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
ঝুমা ওকে ভেঙাল, বিকেলটা দ্রুত ফুরিয়ে আসছে! তোমাকে আর কাব্যিক বক্তব্য দিতে হবে না সোনা, পলি প্রতিদিন এভাবে আসতে পারবে না। আজই একচক্কর দিয়ে যাব।চল।

ঝুমা এই শহরেরই মেয়ে আর বেশ চটপটে।ও গিয়ে গেটের নিরাপত্তা প্রহরীকে অনুরোধ করল।কিন্তু সে কিছুতেই অনুমতি ছাড়া ভেতরে যেতে দেবে না।তাছাড়া এই সময়টায় তো নয়-ই, যখন বিকেল শেষের পথে।
ঝুমাও নাছোড়বান্দা, নানাভাবে চেষ্টা করতে লাগল।পলি-কে দেখিয়ে বলল, আমার এই বান্ধবী অনেক দূর থেকে এসেছে। হয়ত আর কোনোদিন আসতে পারবে না।কিছুক্ষণের জন্য ঢুকতে দিন না!
তবু প্রহরীর মন গলছে না দেখে ও শেষ তীরটা ছুঁড়ল, আপনি আমাকে চেনেন না? আমি কণ্ঠশিল্পী ঝুমা।

নিরাপত্তা প্রহরী ঝুমার এই তীরে ঠিক ঘায়েল হলো।বলল, হ্যাঁ, তাই তো মনে মনে চিন্তা করছি আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে।আপনিই তো গত বছর বিজিবির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন।আহা, আগে পরিচয় দিবেন না! যান, তাড়াতাড়ি একবার ঘুরে আসেন।ভিতরে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে আমার নাম বলবেন।বলবেন, আপনারা সাজু মিয়ার আত্মীয়, টাঙ্গাইল থেকে বেড়াতে এসেছেন।ঠিকাছে আপা? বেশি ভিতরের দিকে যাবেন না, সময় বেশি নাই।

ওরা ততক্ষণে ফুলের বাগানের কাছে চলে এসেছে।বাগানটা এত সাজানো গোছানো আর এত রকমের ফুল যে, ওরা মুগ্ধ হয়ে গেল।অবশ্য যে কেউ-ই মুগ্ধ হবে।

মনা বহুদিন পর কাঁটা মেহেদীর ঝাঁড় দেখল।ফুলবাগানের বাইরের দিকটা সমান করে কাটা কাঁটা মেহেদীর গাছ দিয়ে ঘেরা।ওর ছোটোবেলায় ওদের বাড়ির বাইরের উঠোনও এমন করেই কাঁটা মেহেদীগাছ দিয়ে ঘেরা ছিল।পরে ওগুলো সরিয়ে ইটের পাঁচিল তুলে দেওয়া হয়েছে।

ওরা পুকুরপাড় ধরে আমবাগানের দিকে এগোচ্ছে।পাশাপাশি তিনটি বড়ো বড়ো পুকুর।পূর্বদিকে আরও কয়েকটি দেখা যাচ্ছে।সবগুলো পুকুরের পারে দুসারি সুপারি গাছ, কেবল ফুলবাগানের দিকের পারটাতে একসারি নারকেল গাছ।

আম বাগানটি পুকুরের পার থেকে বেশ নিচুতে।সারি সারি শত শত গাছ আর গাছ ভর্তি আম।কোন অংশে কোন জাতের আমগাছ সেটা ছোটো ছোটো পিলারের সাথে লাগানো শ্বেতপাথরে লেখা রয়েছে।

ওরা যখন আমবাগানের সবুজ ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাগানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছিল তখন উত্তর দিক থেকে ধেয়ে আসছিল কালবৈশাখী ঝড় আর বাগানের দক্ষিণ দিকের পাঁচিলের নিচের চোরাপথে একে একে ঢুকছিল তিনটি ছেলে! এই পথ ওরা বরাবর বাগানের আম চুরির কাজে ব্যবহার করে, কিন্তু আজ ওদের উদ্দেশ্য ভিন্ন।ওরা দেখেছে বাগানের মালি হেলে দুলে বাজারের দিকে যাচ্ছে।আহা হা! এটাই উপযুক্ত সময়; নির্জন বাগান, সন্ধ্যা হতে চলেছে, ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয়ে গেছে। ছেলে তিনটি সন্তর্পণে এগোচ্ছে আদিম নেশার টানে!

কিশোরী সুলভ উচ্ছলতার কারণেই হোক কিংবা অশনিসংকেত হিসেবে, ঝুমা-র বাম কানের দুল হঠাৎ খুলে পড়ে গেছে কোথাও! ওরা তিন বান্ধবী মিলে সেটাই খুঁজছে উদ্বিগ্ন চিত্তে! কারণ ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয়ে গেছে, এদিকে ঝুমা-র খুব শখের কানের দুল, তা-ও আবার সোনার!
তিনজনই স্মার্টফোনের টর্চ জ্বালিয়ে খুঁজতে খুঁজতে একসময় পেয়ে গেল দুলটা।কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে! কালবৈশাখী যেমন শুরু হয়ে গেছে তেমনই ছেলেগুলোও ওদের খুব কাছে চলে এসেছে।

হঠাৎ এমন যৌথ বিপদের মুখে পড়ে ওরা বেশ ঘাবড়ে গেল।কিন্তু চটপটে ঝুমা চটপট নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তোরা মোবাইল ব্যাগে ঢোকা।
ওই মুহূর্তে ওর প্রথম এটাই মনে হলো যে, ছেলেগুলো ছিনতাইকারী।ওরা মোবাইলগুলো ব্যাগে ভরে যখনই ঘুরে দৌড় দেবে ভাবছিল তখনই একটা ছেলে চাকু দেখিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, দাঁড়া, পালানের চেষ্টা কইরলে বা চিক্কুর দিলে একবারে খুন কইরা ফালামু।

বিদ্যুৎ চমকালে ওর হাতের চাকুটা চকচক করে উঠল।
প্রচণ্ড ভয়ে মনা ও পলির গলা শুকিয়ে গেছে, ওরা কোনো কথাই বলতে পারল না।ধমকে উঠল ঝুমা, অ্যাই খবরদার, এক পা আগাবি না। বদমাশ ছেলে-পেলে, আমাদের চিনিস? তোদের জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব।
বিকৃত ভঙ্গিতে হেসে উঠল ছেলেগুলো।একজন বলল, জেলের ভাত পরে খামুনে, আগে একটু…।

তক্ষুনি কাছেই কোথাও বজ্রপাত হলে প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। আর এই সুযোগে ওরা দৌড়াতে শুরু করল।কিন্তু ঝুমা ও পলি উত্তরদিকে দৌড়ালেও মনা বোকার মতো দৌড়াল পূর্বদিকে!
চলবে..