দশম পর্ব
কলেজ স্ট্রিটের রাস্তা ধরে হাঁটেন আলী আকবর খান।আর মনে মনে ভাবেন নজরুলকে নিয়ে। কত বড় আশা নিয়ে নজরুলকে বাড়িতে নিয়ে গেলাম। তরুণ প্রতিভাবান কবি। তাকে ঘরজামাই বানিয়ে কব্জা করে রাখব। একটার পর একটা বই লিখবে। সেই বই প্রকাশ করব আমি। আমার ব্যবসায় সানায় সানায় উন্নতি হবে। আমি হবো বড় প্রকাশক। কলকাতার নামকরা প্রকাশক। এই ভাবনার মধ্যে নিশ্চয়ই আমার কোনো অন্যায় ছিল না! তারপরও কেন সবকিছু এমন এলোমেলো হয়ে গেলো!
আলী আকবর খান একেকজন প্রকাশকের কাছে যান আর নজরুলের কথা জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু কোনো প্রকাশকই নজরুলের খোঁজ দিতে পারলেন না। নজরুল কোথায় আছে, কেমন আছে তাও কেউ জানে না। উল্টা তাকেই তারা বলেন, আপনি না জানলে আমরা কিভাবে জানবো? আমরা তো শুনলাম, সে আপনার সঙ্গেই বেড়াতে গেছে! এখন সে উধাও হয়ে গেলো! এ কেমন কথা বাপু!
বিব্রত আলী আকবর খান কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। তিনি এবার শহরের আনাচে কানাচে খুঁজতে শুরু করলেন। তন্য তন্য করে তাকে খোঁজেন। জনে জনে তার কথা জিজ্ঞাসা করেন। না। কেউ তার খোঁজ দিতে পারেনি। পরে তিনি নজরুলের কাছের বন্ধুবান্ধবদের কাছে খোঁজ নিতে শুরু করলেন। তারাও কেউ কিছু জানে না। খুঁজে খুঁজে তিনি রীতিমতো হয়রান। আর কোথায় খুঁজবেন তাও বুঝতে পারছেন না। এখন তার নজরুলের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সবাই জানে, নজরুল আমার সঙ্গে বেড়াতে গেছে। এখন সে নেই। নেই তো নেই-ই।
আলী আকবর খান মনে মনে বলেন, তার মানে নজরুল কলকাতায় ফেরেনি। তাহলে সে কোথায় গেছে? সে কি আমাদের দেশেই আছে? জরুরি কাজটা তার কোথায়? সত্যিই কি কোনো জরুরি কাজ ছিল তার? তার মানে আমার ভাগ্নির কাছে মিথ্যা বলেছে সে! তাহলে কি সে আর ফিরবে না! এ কী কথা! আমার ভাগ্নির কি হবে? সে তো পাগল হয়ে যাবে! হায় খোদা! তুমি দয়া করো। নজরুলকে না নিয়ে আমি বাড়ি যাবো কোন মুখে?
আলী আকবর খান হতাশ হয়ে পড়েন। তিনি ঠিকমত দোকানে যান না। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করেন না। ঠিকমত ঘুমান না। শয়নে স্বপনে তিনি নজরুলের কথা ভাবেন। কোথায় গেলে নজরুলকে পাবেন তা নিয়ে চিন্তা করেন। এক পর্যায়ে তার বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের কথা তার মাথায় আসে। নজরুল কি তাহলে বীরেন্দ্রদের বাড়িতে! থাকলে ওখানেই হয়তো থাকতে পারে। বীরেন্দ্র সেনের মাকে সে মা ডেকেছে। আমাদের বাড়ি থেকে হয়তো সেখানেই গিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু সেখানে কি এতোদিন থাকবে? তারাও বা কেন এতোদিন তাকে রাখবে! আমি খোঁজ নিতে যাবো; দেখব সেখান থেকেও সে চলে এসেছে। কি দরকার শুধু শুধু সেখানে যাওয়া!
আলী আকবর খান অনেক চিন্তাভাবনা করে মনস্থির করলেন, তিনি আর কলকাতায় নজরুলকে খুঁজবেন না। অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প কিছু দেখছেন না তিনি। অপেক্ষা করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। যখন সময় হবে তখন সে ঠিকই ফিরে আসবে।
আলী আকবর খান এও ভাবেন, নজরুলের এখন চাকরি বাকরি নেই। তার এখন টাকার প্রয়োজন। বন্ধুবান্ধরের কাছ টাকা ধার নিয়ে কদিন আর চলা যায়। তাকে প্রকাশকদের স্মরণাপন্ন হতেই হবে। সেটা আমি হই বা অন্য কেউ। কলেজ স্ট্রিটে এলে নিশ্চয়ই খবর পাওয়া যাবে। তখন তাকে ধরা যাবে। সে আমার বোনের মেয়ের জামাই। কোনো কারণে মান-অভিমান করে থাকতে পারে। সেটা নিশ্চয়ই সে চিরদিন পুষে রাখবে না। ভাঙবে। অথবা আমাদের ভাঙাতে হবে। তার পাশে দাঁড়াতে হবে। টাকা পয়সা দিয়ে সহায়তা করতে হবে।
আলী আকবর খান ব্যবসায় মনোযোগ দিলেন। প্রতিদিন দোকান আর বাসা। বাকি সময় নজরুলের সন্ধান করা। ব্যবসার তরী ভাসাতে হলে নজরুলকে তার বড় প্রয়োজন। তিনি মনে মনে নজরুলকে খোঁজেন। তার জন্য বেশ কিছু টাকা তিনি আলাদা করে রেখেছেন। কলকাতায় ফিরলেই তার টাকার প্রয়োজন হবে। তার থাকা-খাওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা তিনি নিজেই করবেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পরও নজরুলের কোনো দেখা নেই। কোথায় আছে, কেমন আছে তাও জানা গেলো না।
নজরুলকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে আলী আকবর খানের মানসিক যন্ত্রণা শুরু হয়। এই যন্ত্রণাটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে নজরুলের বন্ধুবান্ধবরা। তারা এখন প্রায়ই আলী আকবর খানের কাছে এসে নজরুলের খোঁজখবর জানতে চান। কোনো কোনো প্রকাশকও তার কাছে এসে খবর নেন। তিনি যতই বলেন, আমি তার কোনো খবর জানি না; ততই যেন তারা চেপে ধরেন। তারা বলেন, আপনি জানেন না তো কে জানবে?
মহামুশকিলে পড়ে গেলেন আলী আকবর খান। কোনো উপায়ান্ত না পেয়ে তিনি বাড়িতে তার স্ত্রীর কাছে চিঠি লিখলেন। তাতে তিনি বললেন, কলকাতায় নজরুলকে আমি অনেক খুঁজলাম। কিন্তু তার কোনো হদিশ পেলাম না। সে নাকি কলকাতায় ফেরেনি। তারপরও আমি তাকে খুঁজছি। সে যদি আমাদের বাড়িতে ফিরে যেয়ে থাকে তাহলে অতিসত্বর আমাকে জানাও। আমি তার খবর জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
কিছুদিন পর বাড়ি থেকে আলী আকবর খান চিঠির জবাব পেলেন। চিঠির জবাব দিয়েছে তার বোন আসমাতুন্নেসা। তিনি চিঠিতে বললেন, পর সমাচার এই যে, নজরুলের জন্য আমরাও অপেক্ষায় আছি। তার কোনো খোঁজখবর আমরা পাইনি। সে যদি আবার ফিরে আসে অবশ্যই আপনাকে জানাবো।
বাড়ি থেকে চিঠি পাওয়ার পর আবার চিন্তায় পড়েন আলী আকবর খান। চিন্তায় পড়ে নার্গিসও। নজরুল কলকাতায় যায়নি এ খবর শুনে সে বারবার তার মাকে জিজ্ঞাসা করে, কলকাতায় যায়নি তাহলে কোথায় গেছে মা? সে যে আমাকে বলল, কলকাতায় তার কাজ আছে! তাহলে কি যাওয়ার পথে কোনো সমস্যা হয়েছে! সেই রাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে সে কোথায় গেছে! কুমিল্লা থেকে সকালে কলকাতার ট্রেন ছাড়ে। সকালে সেই ট্রেন ধরতে পেরেছিল! মা, মা কিছু বলো!
মেয়ের সামনে আসমাতুন্নেসা পাথরের মূর্তিও মতো স্থির হয়ে আছে। তার কাছেও বিষয়টা রহস্যজনক বলে মনে হয়। তিনি মেয়ের প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে পান না। কি জবাব দেবেন তিনি? এজন্যই তিনি নার্গিসকে তিনি চিঠিটা দেখাতে চাননি। চিঠি পেয়ে ভেবেছিলেন হয়তো কোনো সুখবর পাবেন। মহাখুশিতে চিঠিটা খুললেন। কিন্তু চিঠি পড়ার পর হতাশায় ভেঙে পড়লেন। তিনি মনে মনে বলেন, নার্গিস কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছিল। নজরুলের বিদায়ের কষ্ট ভুলতে বসেছিল। চিঠিটা যেন কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিল। মেয়ে যদি আবার পাগলামি শুরু করে তাহলে কী হবে! আবার যদি নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দেয়!
আসমাতুন্নেসা নিজের মনের সঙ্গে নিজে কতক্ষণ লড়াই করলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়েকে সাহস দিয়ে বললেন, দুশ্চিন্তা করিস না মা। কলকাতা অনেক বড় শহর। সেখানে সহসাই তোর মামা তাকে খুঁজে বের করতে পারবে তা ভাবার কোনো কারণ নেই। খুঁজে পায়নি বলেই উনি এভাবে লিখেছেন। হয়তো সে কোথাও কাজে রয়েছে। তোকে যখন সে বলেছে, ফিরে আসবে তখন নিশ্চয়ই আসবে।
কিছুতেই নার্গিসের মন মানে না। সে নজরুলকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে উদাসীন হয়ে পড়ে। সে মনে মনে বলে, নজরুল দ্রæত তুমি ফিরে আসো। তোমার নার্গিস অধীর আগ্রহে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
চলবে..