মায়াবন বিহারিণী (পর্ব-৫)
বাবার কাছে গিয়ে মনা জিজ্ঞেস করল, বাবা তুমি, কখন এলে?
তিনি একটা বইয়ে ডুবে ছিলেন।মুখ তুলে মেয়েকে দেখে বললেন, এ-এই তো। তোর একি অবস্থা!
মনা কিছু বলবার আগেই ওর পেছন থেকে বুয়া বলল, তুমি ঝড়-বৃষ্টির মইধ্যে কই আটকা পরছিলা খালা? অমা, ভিজে চুপ চুইপা হয়া আইছ! তোমার আব্বা সেই বিকালে আইছে। তোমারে এই যে কল দিতাছে তুমি ত ধরোই না! অমা, তোমার শরীল সুদ্ধা দেহি কাদা!
বুয়াকে থামাতে মনা চট করে বলল, আরে আপনি অতো অস্থির হবেন না খালা।বৃষ্টি নামলে দৌড়াতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছিলাম।…তুমি একটু বস বাবা, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
মকবুল হোসেন খানের মনে একটু খটকা লাগল, হোঁচট খেয়ে পড়ল বলেই এতটা বিধ্বস্ত দেখাবে মেয়েটাকে! আগে থেকেই ও কোনো সমস্যায় পড়েনি তো? মনা কোথায় ছিল বিকেল থেকে এই পর্যন্ত? ও কেন ফোন রিসিভ করছিল না?
তাকে এতক্ষণ ততটা চিন্তিত না দেখালেও, মেয়ের অমন চেহারা দেখবার পর এসব প্রশ্ন তার মনে ঘোরপাক খেতে থাকল।
বইটা বন্ধ করে মকবুল হোসেন খান তার মেয়ের রুমটায় আবারও চোখ বুলাতে লাগলেন।রুমজুড়ে নানান জিনিসপত্র; ক্যানভাস, রং, তুলি, কাপড় রাখবার আলনা, টেবিল-চেয়ার, টেবিল ভর্তি বই, সিঙ্গেল খাটের বিছানা, রান্নার হাঁড়ি-পাতিল, থালাবাসন ইত্যাদি ইত্যাদি! ছোট্ট একটা রুম আর তাতে এত জিনিসপত্র! এর মাঝে তার মেয়েটা স্বস্তিতে থাকতে পারে? ওর আঁকার নেশা, তার জন্য খোলামেলা জায়গা দরকার, এর মাঝে ও আঁকার কাজ করতে পারে? পরীক্ষার আগের রাতে ও সারা ঘরময় ঘুরে ঘুরে পড়ে, এখানে সেটা সম্ভব হয়? একেই মনে হয় বলে মেসবাড়ির জীবন! তিনি বিএ পাস করেছেন বাড়ির কাছের কলেজ থেকেই।
জন্মাবধি গ্রামেই থাকেন।কোনো কাজ ছাড়া শহরে এসেছেন বলে তার মনে পড়ে না।আবার কাজে এলেও খুব চেষ্টা করেন যেন রাত্রীযাপন করতে না হয়।ফলে শহুরে জীবনযাপনে তিনি মোটেই অভ্যস্ত নন।নিজ এলাকার যেমন বড় ব্যবসায়ী তারা তেমনই তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি। কিন্তু শহরে এলে এখনো তিনি খুব অস্বস্তি বোধ করেন।মনে করেন এদের যে কারোর তুলনায় তিনি কিছুই না!
বসে বসে এমনই এলোমেলো ভাবনায় ভেতরে ভেতরে অস্থির হচ্ছেন মকবুল হোসেন খান।অবশ্য এমন নয় যে, আজই প্রথম তিনি মেয়ের এই রুমটায় এসেছেন, কিন্তু আগামীকাল বিকেলের বিশেষ একটা কাজের জন্য তার মনটা খুবই উতলা হয়ে আছে! সে কারণেই আজ মনা সংক্রান্ত সব কিছুতেই তার অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে এবং আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় সবগুলোই তাকে অস্থির করে তুলছে!
মনা বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই তিনি বললেন, তৈরি হয়ে নাও মা, বাড়িতে যেতে হবে।
মনা হেসে ফেলল, হঠাৎ! তুমি মজা করছ?
ওকে এখন বেশ তরতাজা দেখাচ্ছে।মকবুল হোসেন খান স্বস্তি পেলেন। বললেন, আমি তোমাকে নিয়ে যেতেই এসেছি।
কেন বাবা? কোনোকিছু হয়েছে? বাড়ির সবাই ভালো আছে তো? মা, মেহেদী, আর সবাই?
আহা, এত ব্যস্ত হয়ো না।বাড়ির সবাই ভালো আছে।আসলে কাল বাড়িতে ছোট্ট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি।
কিসের অনুষ্ঠান বাবা? আমি সকালেই মার সাথে কথা বলেছি, মা তো আমাকে কিছু বলল না!
সব ফাইনাল হয়েছে দুপুরের দিকে।তাড়াতাড়ি করো মা, রাত বেড়ে যাচ্ছে।
আগে বল কিসের অনুষ্ঠান।
ওটা আপাতত গোপনই থাক।তুমি তৈরি হয়ে নাও মা।
সেদিন সন্ধ্যার অনেক পরে বাবা মকবুল হোসেন খান-এর সাথে খুশির নীড় থেকে বেরিয়ে গেছিল মনা।ও তখনও জানত না পরদিন পাত্রপক্ষ ওকে দেখতে আসবার কথা ছিল।পছন্দ হলে বিয়েও হবে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু মাঝরাত থেকে ওর প্রচণ্ড জ্বর উঠে গেছিল!
অনেককেই বলতে শোনা গেছিল মনার এতটা জ্বর কোনোদিনও হয়নি। খান বাড়ির সবচেয়ে প্রিয় মেয়েটা অসুস্থ বলে পুরো বাড়ি জেগে ছিল সারারাত।ফজরের নামাজের আগে আগে মকবুল হোসেন খান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সকালেই ছেলের বাবাকে জানিয়ে দেবেন দুদিন পরে আসতে।
আর ফজরের নামাজের পরপরই ঘাম দিয়ে জ্বর নেমে গেছিল মনার। তার একটু পরে ও চোখ মেলে স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, মা, পানি খাব।
মনার মা রাহেলা খানম দ্রুত হাতে এক গ্লাস পানি এনে দিলে ও সেটা ঢকঢক করে গিলে বলেছিল, খুব ঘুম পাচ্ছে মা।বাবা কোথায়?
তোর বাবা নামাজ পড়তে মসজিদে গেছে।কোন নামাজ?
ওমা, ফজরের নামাজ মা।তুই ঘুমিয়ে পড়।
হুম, লাইটটা অফ করে দাও।
রাহেলা খানম দেখেছিলেন সারারাত ছটফট করতে করতে প্রলাপ বকতে থাকা তার মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে।জ্বরের ঘোরে মনা একটা নাম বারবার বলছিল, পূরণ! কে এই পূরণ? ওর নামটাই মনা বারবার কেন বলছিল? একটা অজানা শঙ্কায় তার শরীর শিউরে উঠল।
পরদিন পাত্রপক্ষকে আসতে বারণ করে দেওয়ায় তারা আর কোনোদিনই আসেনি!
সেদিন ফজরের পরে ঘুমিয়ে মনা প্রথমবার পূরণকে স্বপ্নে দেখেছিল। অবশ্য কেবলমাত্র ওর পেছনদিকটা! দেখে স্বপ্নেই চমকে উঠেছিল, সেই লম্বা ও সুঠাম দেহ এবং ফুলহাতা চেক শার্ট!
সেই শুরু।তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই সে স্বপ্নে মানুষটাকে দেখে। কিন্তু কোনোদিনই পরিপূর্ণ মুখখানা মনা দেখতে পায় না।আর বাস্তবে তো সে দেখা দিতেই রাজি নয়।কেন? এই প্রশ্নের সদুত্তর আজও মনা পায়নি।
চলবে..