মায়াবন বিহারিণী (পর্ব-৮) ॥ আরিফুর রহমান


অলঙ্করণ :কাজী জহিরুল ইসলাম

ময়নামতি যমুনার পশ্চিমপারের কুখ্যাত সর্দারপাড়ার জসিম সর্দারের মেয়ে ছিলেন! মকবুল হোসেন খানের দাদা মশাই নাটোর থেকে ফেরার পথে খেয়া নৌকা মিস করে তাদের বাড়ি গিয়েছিলেন রাত্রিযাপনের জন্য।

বহুকাল আগের কথা।
আষাঢ় মাসের শেষ বিকেলে একজন অপরিচিত যুবককে তাদের বাড়ির উঠোনে উঠতে দেখে লাজলজ্জার মাথা খেয়ে অপলক তাকিয়েই ছিলেন ময়নামতি! অমন সুপুরুষ যে তিনি আগে কখনো দেখেননি! তার পলক যেন পড়ছিল-ই না। নড়াচড়া করতেও যেন সায় দিচ্ছিল না তার মন। কিছুক্ষণ পর সম্বিত ফিরে পেয়েছিলেন যখন আগন্তুক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাড়িতে বড়ো কেউ নেই খুকি? একটু ডেকে দাও।

তিনি মোটেই খুকি ছিলেন না, কিন্তু আগন্তুকের কণ্ঠে কী সুন্দর মানিয়ে গেছিল খুকি ডাকটা! ‘একটু ডেকে দাও’ হুকুমটা তাকে ধাক্কা মেরে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে বাধ্য করেছিল। আর তিনিও হুকুম পালনে ছুটছিলেন এ ঘর ও ঘর, আব্বা, আব্বা! কই আপনে?
অথচ জসিম সর্দারের মেয়েকে হুকুম দেয় এমন মানুষ ওই পাড়ায় তখন খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল না!

জসিম সর্দার খুব অবাক হয়েছিলেন, মেয়ে তাকে ডাকছে! অবাক হয়েছিলেন বাড়ির অন্য লোকজনও।কারণ তার বাবার পেশা নিয়ে ঘোরতর আপত্তি ছিল ময়নামতির। আর সে কারণে বহুদিন ধরে তিনি তার বাবার সাথে একটা কথাও বলেন না!

ছোটোবেলা থেকেই তিনি তার নানার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন।বছরে দুয়েকবার দুচার দিনের জন্য বেড়াতে আসতেন বলে জানতেন না কিছুই।একবার ভরা শীতে, তিনি তখন প্রাইমারির শেষ পরীক্ষা দিয়ে ছুটিতে গ্রামে এসেছেন, বাড়িতে পুলিশ এসে জসিম সর্দারকে খুঁজে না পেয়ে খুব শাসিয়ে গেলে মাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে তিনি জানতে পেরেছিলেন তার বাবার পেশা সম্পর্কে।তার বাবা জসিম সর্দার একজন ডাকাত! তারপর টানা তিন বছর ময়নামতি সর্দারপাড়ায় আসেননি।

অবশ্য কেন ময়নামতি সর্দারপাড়ামুখী হন না তা তার নানাবাড়ির কেউ জানতে পারেননি।তার অন্যতম কারণ ময়নামতি ছাড়া ওই বাড়ির সাথে সর্দার বাড়ির আর কারোর কোনো যোগাযোগ ছিল না। তার কারণও সেই ডাকাত জসিম সর্দার।
তিনি মনে মনে স্বীকার করেন যে, তার জীবনের সেরা ডাকাতিটা তিনি করেছেন ময়নামতির মাকেই।

বগুড়া শহরের উপকণ্ঠ থেকে একটি পরিবার দল বেঁধে যমুনায় নৌবিহারে এসেছিল।আনন্দ-উল্লাসে সন্ধ্যা পার হতে চললেও তাদের নৌকা পারে ফিরছিল না।এগিয়ে যাচ্ছিল সর্দারপাড়ার সামনের ডাকাতিয়া ঘাটের পাশ দিয়ে।মাঝি তাদের এই এলাকা সম্পর্কে সতর্ক করেছিল কয়েকবার, কিন্তু তারা কানে তোলেননি।

জসিম সর্দারের বাবা তখনও বেঁচে এবং তিনি আঁখখেতের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে থাকা তার সাগরেদদের ইশারা করেছিলেন নেমে যেতে। জসিম সর্দাররা দ্রুত নৌকাটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন।

আর্থিক দিক বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত তাদের অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল, কারণ নৌবিহারে আসা কারোর কাছেই তেমন মূল্যবান কোনোকিছু পাওয়া যায়নি।তবে জসিম সর্দার পেয়ে গেছিলেন তার জীবনের সবচেয়ে অমূল্য সম্পদ। মেয়েটিকে একপলক দেখেই তার খুব ভালো লেগেছিল।
তাই তিনি তাকেই তুলে নিয়েছিলেন নিজেদের নৌকায়।যদিও তার হাতে দেশীয় অস্ত্র ছিল, কিন্তু ওটা ধরে রাখায় কোনো নির্মমতা ছিল না। তিনি অবাক হয়েছিলেন, মেয়েটি তেমন ভয় পায়নি কিংবা চিৎকারও করেনি।

পরদিন সকালে পাড়ার সবাইকে অবাক করে দিয়ে একদল পুলিশের সামনেই মেয়েটি তার বাড়ির লোকদের বলেছিল, এখানে আমাকে কেউ জোর করে আনেনি। আমি নিজের ইচ্ছাতেই এসেছি, আর ফিরে যেতেও চাই না।

রাতেই অবশ্য দুজনের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল এবং তখনও মেয়েটা কোনো আপত্তি করেনি।
শেষ রাতের দিকে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে জসিম সর্দার জানতে চেয়েছিলেন, বুইঝলাম না, তুমি একবারও আপত্তি জানাইলা না ক্যা? ভয়ও ত’ সেরাম পাও নাই।

স্বামীর চওড়া বুকের জমিনে হাত রেখে ময়নামতির মা সেদিন বলেছিলেন, আপত্তি করলে আপনে খুশি হইতেন? …মেয়েরা ঠিক বুঝতে পারে কোনটা প্রেমিক পুরুষের স্পর্শ আর কোনটা ডাকাতের।
কি বুলছ? আমি ত ডাকাইত-ই।
হ, ডাকাত! ছাড়েন, ফজরের আজানের সময় হইছে।
সেই থেকে দুই বাড়ির মানুষের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল না।

ময়নামতি একটু বড়ো হলে জসিম সর্দারের স্ত্রী-ই একটা চিঠি লিখে যমুনার পারে দেখা হওয়া তার এক বান্ধবীর সাথে ওকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাপের বাড়ি।তার বিশ্বাস ছিল বড়ো ভাই ময়নামতিকে ফেরত পাঠাবেন না।বিয়ের পর সেই প্রথম ওই বাড়ির সাথে সম্পর্কটা মেপে দেখবার সুযোগ তার সামনে এসেছিল।

জসিম সর্দার অবশ্য কিছুটা আপত্তি জানিয়েছিলেন মেয়েকে ওখানে পাঠাতে।কিন্তু তার স্ত্রী তাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, দেখেন, এখানে আশেপাশে একটাও স্কুল নাই।ওরে পড়ালেখা শিখাইতে হইবে না? আপনে কি চান এ-পাড়ার সব ছেলে-মেয়েদের মতন আপনের মেয়েও অশিক্ষিত থাকুক? নাকি চান আপনের মেয়ে ডাকু রানী হয়ে দলের হাল ধরুক?
কি বুলছ? কিন্তু…

চলবে..