কোনো কিন্তু নাই।অনেক চেষ্টা করেও আমি আপনেরে এই পেশা ছাড়াইতে পারি নাই।আমি ফেল! কিন্তু আমি চাই আমাগো মেয়ে পড়ালেখা করুক।আমি ওরে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে চাই।সেটাই আমার জীবনের পাস!
সত্যি সত্যিই তার নিঃসন্তান বড়ো ভাই-ভাবী ময়নামতিকে পরম মমতায় বুকে টেনে নিয়েছিলেন।ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন প্রাইমারিতে। সেখানে থেকেই ময়নামতি নিম্নমাধ্যমিক পাস করে দু-বছর আগে বাড়ি ফিরেছে এবং এসেই বাবার পেশা পরিবর্তনের জন্য খুব চেষ্টা চালিয়েছে। অবশ্য জসিম সর্দারের সাথে সরাসরি সে কোনো কথা বলে না।
শেষে মেয়ের অভিমান বুঝতে পেরে তিনি ধীরে ধীরে দলের দায়িত্ব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন, আর বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন ছোটো ভাইয়ের ছেলেকে।সেই ছেলে আবার বছর খানেক ধরে ময়নামতিকে মনে মনে পছন্দ করে এবং অপেক্ষায় আছে দলের সর্দার হয়ে গেলেই জ্যেঠাকে সরাসরি প্রস্তাব দেবে।ভেবে রেখেছে, সোজা কথায় কাজ না হলে প্রয়োজনে বাড়িতে রক্তের বন্যা বইয়ে দেবে।
তেমনই দিনগুলোর একটিতে সর্দার বাড়িতে পা রেখেছিলেন বড়ো খান সাহেব, মানে মকবুল হোসেন খানের দাদা মশাই।
বহুদিন পর মেয়ের ডাকে বাষ্পপূর্ণ হয়ে উঠেছিল জসিম সর্দারের দুচোখ! পাষাণ হৃদয়ও গলে গেছিল হঠাৎ! চেহারার কাঠিন্য মুছে গিয়ে ফুটে উঠেছিল আবেগ! আর আগন্তুকের আশ্রয় প্রার্থনা বিনা বাক্য বেয়ে মঞ্জুর হয়েছিল।
জসিম সর্দার কখনো ভাবেননি তার কাছে কেউ আশ্রয় চাইতে আসতে পারে।কারণ তিনি ডাকাতদের সর্দার! সর্দারপাড়া মূলত ডাকাতপাড়া! সেই পাড়ায় কোনো অপরিচিত মানুষ দূরে থাক আশে-পাশের গ্রামের পরিচিত মানুষজনও ঢুকতে সাহস পেত না।
মাগরিবের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে বড়ো খান সাহেব জসিম সর্দারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এ পাড়ায় মসজিদ নাই? আযান শোনা গেল না।
বহু বছর পর জসিম সর্দার লজ্জা পেয়েছিলেন, সত্যি তো এ পাড়ায় একটা ওয়াক্ত মসজিদও তো নাই।
সারা পাড়ার লোকজন মাঝরাত অব্দি অতিথির কাছ থেকে দ্বীন দুনিয়ার কথা শুনেছিলেন।শুনেছিলেন দেশের মানুষের কষ্টের কথা, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুফলের কথা।
পরদিনও অতিথিকে থাকতে হয়েছিল।কারণ সূর্যোদয়ের পরপরই পাড়ার কয়েকজন জসিম সর্দারের বাড়ির বাইরের উঠোনে মসজিদ নির্মাণের কাজে লেগে গেছিলেন।শনের ছাউনি ও পাটখড়ির বেড়া দিয়ে দুপুরের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেছিল সর্দারপাড়ার প্রথম মসজিদ।
কীভাবে যেন খবর ছড়িয়ে পড়েছিল আশে-পাশের গ্রামে।ফলে সেই মসজিদ এবং সর্দারপাড়ার লোকজনের এমন অবিশ্বাস্য পরিবর্তন ঘটানো মানুষটাকে দেখতে দু-তিন গ্রামের মানুষ এসেছিলেন একের পর এক, দল বেঁধে।বাদ আছর যে দলটি এসেছিল তারই একজন ভক্তিভরে বড়ো খান সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাবাজী রে ত দেখতে পীরসাবের মতন লাগে! বাবা, আপনে কি পীর-এ-কামেল?
মনে মনে আঁতকে উঠেছিলেন বড়ো খান সাহেব, এই ধারণা তিনি কারোর অন্তরে জন্মাতে দিতে চান না।
বিদায় নিয়ে একটু পরই বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি।যদিও বাদ জোহর-ই শেষ নৌকা ঘাট ত্যাগ করে গেছিল পূর্ব পারের দিকে।আর সবার থেকে বিদায় নেওয়াও ছিল বেশ কষ্টকর।তবু তিনি হাঁটতে হাঁটতে যমুনার পারে এসে দেখেছিলেন ঘাটে কয়েকটি জেলে নৌকা।সন্ধ্যা মিলিয়ে যেতেই ওগুলো ভাসতে শুরু করবে নদীর বুকে।
রাতটা ওদের কোনো নৌকায় কাটিয়ে সকাল সকাল খেয়া নৌকা ধরবেন ভেবেছিলেন বড়ো খান সাহেব।কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।তক্ষুণি সর্দারপাড়ার একজন লোক দৌড়ে এসে তাকে জানিয়েছিল, তিনি ফিরে না গেলে সর্দারের বাড়িতে বড়ো কোনো অঘটন ঘটে যাবে।
বড়ো খান সাহেব মুচকি হেসে বলেছিলেন, কিচ্ছু হবে না।তুমি ফিরে যাও, আর তাকে বলো আমি এই ঘাটেই তার অপেক্ষায় থাকব।
লোকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কারে বুলব?
সে তুমি ও বাড়িতে ফিরে গেলেই বুঝতে পারবে।
জসিম সর্দারের বাড়িতে তখন তাঁর সমালোচনা করেছিল কেউ কেউ। বাপদাদার পেশা ছেড়ে হঠাৎ সবার সাধুসন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া পছন্দ হয়নি যাদের, তারা-ই চেষ্টা করেছিল জসিম সর্দারসহ ডাকাতদলের অন্যান্য সদস্যদের খেপিয়ে তুলতে।
চলবে..