হারুকি মুরাকামির গল্প Sleep ॥ অনুবাদ মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ


গল্প : Sleep
মূল : হারুকি মুরাকামি
অনুবাদ : মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
পর্ব : ১

[যোগসূত্রের পাঠকদের জন্য হারুকি মুরাকামির গল্প Sleep এর প্রথম পর্ব ছাপা হলো ]

ঘুম

আজ আমার ঘুমহীন সপ্তম দিন। না, ইনসমনিয়া নয়। ইনসমনিয়া কী তা আমি জানি। কলেজে পড়ার সময়ে আমার একবার ইনসমনিয়ার মতো কিছু একটা হয়েছিল। কিছু একটা বললাম এই কারণে যে, আমার যা হয়েছিল তা আদৌ ইনসমনিয়া ছিল কিনা তা আমি আজও নিশ্চিত নই। সম্ভবত ডাক্তাররা বলতে পারতেন। কিন্তু আমি তখন ডাক্তারের কাছে যাইনি।

ভেবেছিলাম গিয়ে কোন কোনো লাভ হবে না। এই ভাবনার পেছনে আমার যে খুব সঙ্গত কারণ ছিল, তাও নয়। তবুও একজন মেয়ে মানুষের ইনটুইশন থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, তারা কেউই আমাকে কোনভাবেই সাহায্য করতে পারবেন না। সুতরাং আমি তাদের কাছে যাইনি। এমনকি পিতামাতা বা বন্ধুদের কাছেও বিষয়টা চেপে গিয়েছিলাম। কারণ, আমার কাছে নিশ্চিত মনে হয়েছিল যে, তারা সকলেই আমাকে ডাক্তারের কাছেই যেতে বলবেন।

আমার সেই ‘ইনসমনিয়ার মতো কিছু একটা’র সময়কাল ছিল এক মাস। এই সময়ে আমার ঘুম হতো না। রাতে বিছানায় গিয়ে আমি মনে মনে আওড়াতাম, ‘এখন আমার ঘুমানোর সময়।’ অথচ এই কথাটাই আমাকে জাগিয়ে রাখত। এটাই ছিল আমার স্নায়ু থেকে প্রত্যক্ষ ও তাৎক্ষণিক সাড়া। ফলে আমি যত বেশি ঘুমানোর চেষ্টা করতাম, তত বেশিই সজাগ হয়ে উঠতাম।

একবার অ্যালকোহল পান করে ও ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কোনই ফল দেয়নি। প্রতিদিন সকালে ভোরের আলোতে যখন আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠত, শুধু তখনই আমার চোখ ক্লান্তিতে বুজে আসত। কিন্তু সেটাও ঘুম ছিল না। তখন আমার হাতের আঙুলগুলো ঘুমের সবচেয়ে বাইরের প্রান্তকে ছোঁয়ার চেষ্টা করত। এই পুরো সময়েই আমার মন জেগে থাকত। আমি তন্দ্রার মতো কিছু একটা অনুভব করতাম। কিন্তু আমার মন জেগে থাকত একটা স্বচ্ছ দেয়ালের ওপারে। আমার শরীর সকালের মৃদু আলোতে ভাসতে থাকত। মন ঠিক তার পেছনেই তাকিয়ে থাকত। শ্বাস-প্রঃশ্বাস গ্রহণ করত। শরীর থাকত ঘুমের প্রান্তদেশে। অথচ মন জেগে থাকত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে যে সে ঘুমাবেই না।

আমার এই অসম্পূর্ণ তন্দ্রাবস্থা দিনভর চলত। পুরো সময়েই মস্তিষ্ক কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে থাকত। ফলে আমি আমার চারপাশের জিনিষগুলোকে সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারতাম না। বিশেষ করে দূরত্ব, ভর ও রঙকে। এই আচ্ছন্নকারী তন্দ্রা আমাকে সাবওয়ে, ক্লাসরুম বা ডিনার টেবিল– সকল স্থানেই দখল করে রাখত। ঢেউয়ের মতো একটু পরপর বিরতি নিয়ে। এক সময়ে আমার মন শরীর থেকে বেরিয়ে যেত। পৃথিবীটা দুলতে থাকত নিঃশব্দে। আমার হাত থেকে জিনিস পড়ে যেত। পেনসিল, ওয়ালেট, কাঁটাচামচ মেঝের উপরে গড়াগড়ি দিত। আমি শুধুই চাইতাম বিছানায় নিজেকে ছুঁড়ে দিতে এবং ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু পারতাম না। অনিদ্রা আমাকে ছাড়ত না। সারাক্ষণ পাশে পাশে ঘুর ঘুর করত। আমি তার শীতল ছায়াকে অনুভব করতাম। অদ্ভুত তন্দ্রার ভেতরে আমি অনুভব করতাম যে, আমি আমার ছায়ার ভেতরে ঢুকে গেছি। তন্দ্রার ভেতরেই হাঁটতাম, খাওয়া-দাওয়া করতাম এবং মানুষজনের সাথে কথা বলতাম। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার ছিল যে, কেউই আমার ব্যাপারটা খেয়াল করত না।

সেই মাসে আমি ১৫ পাউন্ড ওজন হারিয়েছিলাম এবং দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কেউই তা লক্ষ্য করেনি। এমনকি আমার পরিবারের, বন্ধুদের বা ক্লাসমেটদেরও কেউই কখনই বুঝতে পারেনি যে, পুরো সময়টাতেই আমি জেগে জেগে ঘুমাচ্ছিলাম। একটা ডুবে যাওয়া শবের চেয়ে আমার অনুভূতি বেশী ছিল না। পৃথিবীতে আমার অস্তিত্ব, জীবন দুটোকেই মনে হত হ্যালুসিনেশন বা মায়া। প্রবল বাতাসের ভেতরে মনে হতো আমার শরীর পৃথিবীর শেষ প্রান্তের দিকে উড়ে যাচ্ছে। এমন কোন স্থানে, যেটা আমি কখনই দেখিনি অথবা যার কথা শুনিনি। যেখানে যাবার পর আমার আত্মা ও শরীর পরস্পর থেকে চিরকালের জন্যে পৃথক হয়ে যাবে। নিজেকে আমি শক্ত করে ধরে রাখতে বলতাম। কিন্তু বাস্তবে ধরার কিছুই ছিল না সেখানে।
তারপর দিনের শেষে রাত আসত। তখন আমার ভেতরে সেই প্রবল জাগ্রত অবস্থা ফিরে আসত। কোন শক্তিই ছিল না আমার সেটাকে প্রতিহত করার। একটা প্রকাণ্ড শক্তি আমাকে তার কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখত।

আমি যা পারতাম, তা হলো পরেরদিন সকাল পর্যন্ত অন্ধকারের ভেতরে খোলা চোখে জেগে থাকা। এমনকি কোন চিন্তাভাবনাও করতে পারতাম না। শুধু শুয়ে শুয়ে ঘড়ির সেকেন্ডের কাটা ঘোরার শব্দ শুনতাম। অন্ধকারের দিকে নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে থাকতাম। দেখতাম অন্ধকার গভীর হতে হতে, এক সময়ে আবার ফিকে হয়ে যাচ্ছে।

অতঃপর একদিন কোন ধরনের পূর্ব সতর্কতা বা বাইরের কোন কারণ ছাড়াই আমার এই অবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটল। আমি ব্রেকফাস্ট টেবিলে জ্ঞান হারালাম। আবার জ্ঞান ফেরার পর কাউকে কিছু না বলেই দাঁড়ালাম। আমি হয়ত কিছু একটা ধাক্কা দিয়ে টেবিল থেকে ফেলে দিয়েছিলাম। মনে হয় কেউ একজন আমার সাথে কথাও বলেছিল। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই। দুলতে দুলতে নিজের কক্ষে ফিরে আসলাম। হামাগুড়ি দিয়ে বিছানায় উঠলাম। এবং দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লাম।

সাতাশ ঘণ্টা আমি ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলাম। আমার মা ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই আমাকে জাগানোর চেষ্টা করতেন। একবার আমার গালে কষে থাপ্পড়ও মেরেছিলেন। কিন্তু আমি নিরুদ্রপভাবে সাতাশ ঘণ্টা ঘুমিয়েছিলাম। কোন ধরনের বিরতি ছাড়াই। অবশেষে আমি চূড়ান্তভাবে জেগে উঠেছিলাম। পুনরায় ফিরে পেয়েছিলাম আমার পূর্ব স্বত্বা।

চলবে..