নোবেল সাহিত্য পুরস্কারজয়ী লেখক আবদুলরাজাক গুরনাহ বলেছেন, আন্তর্জাতিক পাঠক ধরার জন্য নয় বরং নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের কারণেই ইংরেজি ভাষাতে লেখালেখি করেছি।লেখার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে বেছে নেওয়ার কারণ বিষয়ক এক প্রশ্নে রোববার (৮ জানুয়ারি ২০২৩) ঢাকা লিট ফেস্টের এক অধিবেশনে এমন উত্তর দেন তানজানিয়া বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এই লেখক।
২০২১ সালে নোবেল পুরস্কার জয়ী গুরনাহ বলেন, আমি কোন ভাষায় লিখব তা নিয়ে চিন্তা করছি কিংবা ইংরেজিতে লিখলে আন্তর্জাতিক পাঠক পাওয়া যাবে- এমন বিষয় আমার ক্ষেত্রে কখনও ঘটেনি।
আরও পড়ুন: চা বানাচ্ছিলেন, ফোন করে বলা হয় ‘আপনি সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন’
“এসব আমার কাছে কোনো বিষয় ছিল না বা আমার ক্ষেত্রে ঘটেওনি। ইংরেজি এমন একটা ভাষা যাতে আমি স্বচ্ছন্দ্য ছিলাম। সেটাতেই আমি লেখা চালিয়ে গেছি এবং এখনও আমি তেমনই অনুভব করি।”
ইংরেজিতে সাবলীলভাবে লেখার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “ভাষা নিয়ে কোনো ধরনের চিন্তা না করেই আমি ইংরেজিতে লিখতে পারি। আমি লেখার সঠিক সমন্বয় পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি যত্নবান ছিলাম। এভাবেই চলছে, এটা একটা ভাগ্য।”
এদিন ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে দশম এ সাহিত্য আসরের শেষ দিনে ‘ডেজার্শন’ শীর্ষক অধিবেশনে নিজেদের বেড়ে ওঠার গল্প শোনানোর পাশাপাশি লেখক হয়ে ওঠার পথচলা তুলে ধরেন গুরনাহ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন গুরনাহ এর বিভিন্ন বইয়ের সম্পাদক ও ব্রিটিশ প্রকাশক আলেকজান্ড্রা পিঙ্গেল।
আগের দিন শনিবার (৭ জানুয়ারি ২০২৩) নিজের লেখালেখি এবং সাহিত্য নিয়ে কথা বলেন নোবেল বিজয়ী এ লেখক ও সাহিত্যের শিক্ষক।
গুরনাহর জন্ম ১৯৪৮ সালে তানজানিয়ার জানজিবারে, যে দেশ পর্তুগিজ, ওমান ও ব্রিটিশ শাসনে ছিল কয়েকশ বছর। তার গল্পের অনেক চরিত্রের মতো তিনি নিজেও একজন শরণার্থী হয়ে ১৯৬০ এর দশকে ইংল্যান্ডে পা রাখেন।তারপরের জীবনের বড় একটা সময় কেটেছে কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে।সর্বশেষ সেখানে তিনি ইংরেজি আর পোস্ট কলোনিয়াল সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন।
অনুষ্ঠানে লেখার ভাষা বেছে নেওয়ার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে জানজিবারে স্কুলে পড়ার সময় এক শিক্ষক তার ইংরেজিতে দক্ষতার কথা বলেছিলেন বলে উল্লেখ করেন গুনরাহ।
ইংরেজির সঙ্গে তার এক ধরনের ‘বন্ধনের’ কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “শিশুকালে স্কুলেও আমি ইংরেজিতে ভালো করেছিলাম। এটা এমন দক্ষতা, যা আমার মধ্যে ছিল।
“আরেকটা বিষয় হচ্ছে আমি ইংরেজিই পড়ছিলাম, ইংরেজি বই পড়ছিলাম।পড়া ও লেখার মধ্যে অন্তরঙ্গ সংযোগ আমরা সবাই জানি। আমার মনে হয়, যখন আমি লিখতে আসি, তখন ইংরেজিতে লেখাই ছিল আমার জন্য সহজ।মায়ের কাছে চিঠি লেখা ছাড়া বাকি সবকিছু ইংরেজিতে লেখা ছিল আমার কাছে সহজতর।”
আরও পড়ুন: আবদুলরাজাক লিখেছেন আপসহীনভাবে শিকড়হীন মানুষের বেদনা
খুব ছোটো বেলায় জানজিবার বন্দরে আসা বিদেশি জাহাজ ও তাতে চড়ে আসা নানা ভাষা-সংস্কৃতির মানুষের জীবনাভিজ্ঞতা দেখার কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন তিনি।
গুরনাহ বলেন, বিভিন্ন আকারের শত শত জাহাজ বন্দরে নোঙর করত। কিন্তু সেইলিং বোটে থাকার ব্যবস্থা না থাকায় নাবিকরা কূলে নেমে আসত। খালি জায়গায় বিছানা পেতে থাকত তারা।
“আগ্রহের দিক থেকে এটা ছিল বেশ। কারণ এটা বিশ্বকে আমাদের কাছে নিয়ে আসত। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের স্থায়ী অবস্থান জানজিবারে ছিল। যখন বড় সংখ্যায় বাইরের মানুষ আসার কথা বলছি, তখন বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি ও বহু রকমের খাবার আর তারা মূলত কালচে হত, তাদের সমুদ্রে কষ্টকর যাত্রার কারণে।এক ধরনের হুড়োহুড়ি আর চেঁচামেচি লেগেই থাকত।”
১৯৬৪ সালে জানজিবারে বিপ্লব শুরু হলে ১৩ বছর বয়সী শিশুমনে কী রকম প্রভাব পড়েছিল, তা স্পষ্ট মনে থাকার কথা তুলে ধরেন এ লেখক। ছোটোবেলায় কী বই পড়তেন- এমন প্রশ্নে গুরনাহ বলেন, অতো বই পাওয়া যেত না, তবে সামনে যা পেতেন গোগ্রাসে পড়তেন তিনি।
“যদিও অতো বেশি কিছু পাওয়া যেত না, তবুও সামনে যা পাওয়া যেত আমি তাই পড়তাম।জানজিবারে বহু ধরনের বই আসার ব্যবস্থা ছিল না। বই কেনার ধারাও মানুষের মধ্যে সেভাবে ছিল না।কিছু বই পাওয়া যেত স্কুলে।”
১০ বছর বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে তিন মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন থাকার স্মৃতিচারণ করে তিনি হাসপাতালের বিছানায় শুনে সবগুলো পাঠ্যপুস্তক মুখস্ত করে ফেলার কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।
‘মঞ্চের তারকা নয়, আমার আগ্রহ সাধারণ জীবনে’
পাঠকনন্দিত লেখক হওয়ার পেছনে স্বচক্ষে দেখা প্রাত্যহিক জীবনে সাধারণ মানুষের জটিলতা আর চিন্তাকে ধারণ করে কলম ধরার কথা বলেছেন গুরনাহ।তিনি বলেন, “আমি তাদের নিয়ে আগ্রহী নই, যারা মূল মঞ্চ দখল করে থাকে বা যারা পত্রিকার পাতায় থাকেন। কারণ, তারা ইতোমধ্যেই সেখানে অবস্থান করছেন, তাদের কাজ তারা করে যাচ্ছেন।
“আমি মনে করি, সাধারণ মানুষের জীবনের জটিলতা নিয়ে আমি বেশি পরিমাণে আগ্রহী। কারণ, সেই জীবনেই আমাদের সবার বসবাস। আর সেখানেই মানুষের সংশয় ও কষ্টগুলো প্রতিভাত হয়; আর এটা প্রতিফলিত হয় না বড় মঞ্চে কিংবা সংবাদপত্রে।”
সাধারণের জীবন নিয়ে আগ্রহী হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ২০২১ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কারজয়ী এই লেখক বলেন, “সুতরাং এটি একটি অভূতপূর্ব প্রতিশ্রুতির মতো নয় যে আমি ছোট জীবনে আগ্রহী, এটিই আমি।আমি মনে করি যে স্থান এবং লোকদের সম্পর্কে লেখা হয়েছে, তা আমার কাছে আকর্ষণীয়।
“আমি নায়কদের সাথে কাঁধ মিলাই না; আমি এমন লোকদের সাথে কাঁধ মিলাই যাদেরকে জীবন চালিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটার সঙ্গে মানিয়েও নিতে হয়। আসলে সাধারণ মানুষ কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে লেখার চেয়ে হিরোদের সম্পর্কে লেখা আমার জন্য বড় চাপ। এবং শেষ পর্যন্ত এটি বলি যে, আসুন এই ছোট জীবনগুলিকে অবহেলা না করি।”
কাদের জন্য লেখেন- দর্শকসারি থেকে এমন প্রশ্নে গুরনাহ বলেন, “আমি কার জন্য বলি, সেটা আমি জানি; আর সেটা হচ্ছি আমি নিজে। লেখার দৃষ্টিকোণ নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই, কারণ আমি যা-ই দেখি, তা-ই প্রকাশ করি। তার মানে এই নয় যে আমি নিজস্ব কোনো বুদবুদের জন্য বাস করি।
“আমি এমন কিছু প্রকাশ করি, যা আমি জানি, যা দেখি আর সেটাই আমার মতো। যখন লিখি, তখন আমি চাই যে, এটা পড়ছে সে যেন বলতে পারে- এভাবেইতো আমি বিষয়গুলোকে দেখছি কিংবা বলতে পারে যে, আমিওতো এটা নিয়ে ভেবেছি, এটা খুব কৌতূহল উদ্দীপক। অথবা বলতে পারে, কিচ্ছু হয়নি, এটা একটা আবর্জনা।”
নিজে যখন অন্যের লেখা পড়েন, তখনও তার কাছে একই রকমের অনুভূতি হওয়ার কথা তুলে ধরে গুরনাহ বলেন, “আমি যখন কোনো নতুন লেখা পড়ি, আমার প্রতিক্রিয়াও এমনিভাবে হয় যে, এটা আমার কাছে নতুন নয়, তবে আমি এটাকে এভাবে চিন্তা করিনি।”
তিনি আরও বলেন, “কার জন্য বলি, সেই প্রশ্নের উত্তর- সবার জন্য। আমার এটা নিয়ে কখনও দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ ছিল না যে, আমার পাঠক কে? আমি শুধু ভেবেছি, আমি লিখছি যাতে যে কেউ চাইলেই এটা পড়তে পারবে।”
তথ্যসূত্র ও ছবি:
১।বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
২। প্রথম আলো
৩। বাংলা ট্রিবিউন