নির্বাচিত দশ কবিতা ॥ আবু আফজাল সালেহ


পেইন্টিং: সমর মজুমদার

সপ্তর্ষির মতো স্বাধীন

যখন বিকেল নামে উপত্যকায়
পাহাড়ের ওপারে সূর্যাস্ত
জ্বলজ্বল করে

লেকের মধ্যে শাপলার কোলে
মাছিদের গুঞ্জনে
দেবদারু, ঝাউবনের বুনো স্বাধীনতা।
যখন সন্ধ্যা জড়ো হয়
ছোট প্রাণীরা দৌড়ায়-নীড়ের দিকে
তারপর রাতের নিস্তব্ধতা
ছোট প্রাণীদের উন্মাদনায়

আমি স্বাধীন
আমার মস্তিষ্ক স্বাধীন-সপ্তর্ষির মতো।

চুম্বন করি অঙ্কুরে
আমার শিরা ভেদ করে অঙ্কুর
তুমি তার সামনে মাথা নত কোরো।

তার ছোট্ট -পর্শ
একটি কঠোর কমান্ডের সমান
তোমার ভালোবাসার সমান।
আমি চুম্বন করি অঙ্কুরে।

ভালোবাসা, পদ্মা-গঙ্গা পেরিয়ে
আমি তোমাকে ভালোবাসি বললে,
শুধু মিথ্যে বলা হবে

বরং বলি, হাতে হাত রেখে চলি
ঘুরি বাংলাবান্ধা থেকে সেন্টমার্টিন
শ্যামনগর থেকে জকিগঞ্জ
পদ্মা-গঙ্গা পেরিয়ে শান্তিনিকেতন।

অবশেষে, পদ্মা-মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরের
উদার জলতলে ঝাঁপ দেই,
তার আগে স্মৃতিমোড়া আমার মাথাভাঙ্গায়
অশ্রুজল ফেলে যাব।

বুনো ভালোবাসার কাছে
দূরে শিশিরভেজা উপত্যকায়
বকবক ঝরনা
হেমন্তের পাহাড়ের ঝোপঝাড়ে
ঝাঁপিয়ে পড়ে পাখিরা
উল্লাসে উল্লাসে।

পাহাড় আমাদের দেওয়াল হতে চায়
তবুও দীর্ঘরাতগুলো মধুর হয়
তারারা কথা বলে
তোমার বুনো আপ্যায়নে।
আলোড়ন, কোলাহল ছেড়ে
বুনো ভালোবাসার কাছে
ছেড়ে দিতেই হয় আমাকে।

তোমাকেই দেখি
গোলাপের মতো ভোরে
পর্বতের মতো নির্বাক, রহস্যময়
তারার সঙ্গে তারারা কথা বলে
ধূসর আলোয় ঘুমোয় পৃথিবী।

নাম না-জানা একটি নদীর উপর
নক্ষত্র জ্বলছে
আলোর কোষ ভেঙে দ্বিগুণ হচ্ছে প্রতিবার
কুয়াশায় চকচকে মেঠোপথ জ্বলমল করে
জ্যোৎস্নার মাতাল উল্লাসে।

এই পথ এই ভোরে
নদীর স্রোতে শুধু তোমাকেই দেখি।

 খাসিয়া তরুণী
জাফলংয়ের পিয়াইন নদীর তীরের বাজার
চারজন খাসিয়া তরুণী-স্কার্টপরা, স্বাস্থ্যবতী-
দাম-দর করছে কাঁঠালের।

হৃৎপি-টা কেঁপে ওঠে বারবার
চোখ দুটো সরতে চায় না মোটেও
পাথুরে স্রোতে নুড়ি-পাথরের ন্যায় ভেসে যায়

বোধ, বিবেক, শরম
তাদের চোখগুলো আমার খুনের আসামি।

সহযাত্রী বন্ধু ফিসফিস করে বলল,
দ্যাখো-দ্যাখো
ওদের চোখে কী শক্তি!

ওদের বড়-গোল চোখ যেনো বিষ্মিত, ভয়ার্ত
চোখরশ্মি দিয়ে বের হচ্ছে হাজারও জিজ্ঞাসা-
অবহেলার প্রশ্ন-খোঁজা

কিন্তু আত্মবিশ্বাসে প্রবল জোর
ঘামের প্রতি যৌক্তিক মূল্যায়ন।

অন্ধকার ঠেলে থাকুক আমার পাশেই
সম্ভবত নগ্ন চিম্বুক পাহাড়ে
এবং আশে-পাশে নীলগীরিতে
সবুজের-পর্শ পথে শুভ্র মেঘের ছোঁয়ায়
কান পেতে শুনি

ঝিঁঝির ডাক, প্রাণদের আড্ডা, গুল্ম-তৃণদের হৈ-হুল্লোড়।
পেছন থেকে ডাকে গুল্মলতা,
-‘কে? কে যাও তুমি?’

পেছনে ফেরার মুহূর্তে মুহূর্তে
লোমশ বর্ণিল ছোঁয়া,
মগজের খোরাক জোগায়, দেহের ক্লান্তি সরে

কোমল-পর্শের বুননে বুননে।

অথচ সেখানকার তরুণ মেয়েরা ভালবাসা থেকে অনেক দূরে
তরুণ যুবারা আলো থেকে অনেক দূরে
শিশু-বৃদ্ধদের প্রাণই আছে শুধু
কাছে থেকেও তারা দূরে
দূরে থেকে আমরা অনেক কাছে।
অন্ধকার ঠেলে ওরা থাকুক আমার পাশেই।

এইখানে অচেনা সুর
অচেনা সুর যন্ত্রের নগরে-এইখানে
স্বর্গ দেয় ইশারা ওইখানে।
চলো যাই, যেখানে ফিঙে নাচে সুবর্ণভূমিতে
যেখানে দোয়েল শিস দেয় সবুজ ঘিরে।

এইখানে সব কৃত্রিম
এইখানে মমতা নেই একটুও
ওইখানে সব আছে
সবুজের মাঝে ভালোবাসাটুকু পেখম মেলে।

এইখানে চাঁদ নামে না
এইখানে স্রোত বয়ে চলে না
ওইখানে তবু আছে কিছু
জাহাজ-লঞ্চ চলে না আর
তবে ডিঙি-নৌকা আছে কলমি-হেলেঞ্চা বনে।

ওই দুটি চোখ সামলে রেখো
সাগর-দ্বীপে দুটি হ্রদ
ফসফরাসের মতো জ্বলজ্বল করে,
নেশা ধরায়
মস্তিষ্কে।

চোখ মুখ বুকে অত্যাচার করে
অহর্নিশ।
মায়াবিনী, ওই দুটি চোখ সামলে রেখো
তবে, ওই মুখম-ল আশির্বাদে রেখো।