যাওয়া-আসার পথের ধারে (পর্ব-৩) ॥ প্রবীর বিকাশ সরকার


মানুষের জানার এবং দেখার আগ্রহ চিরন্তন। না দেখলে যেমন জানা যায় না, তেমনি না জানলে জ্ঞান অর্জন হয় না। যে মানুষ যতবেশি দেখেন এবং জানেন তিনি ততই জ্ঞানী। পৃথিবীতে তাই যুগে যুগে সব সমস্যা ও সংকটের সমাধান দেখান জ্ঞানীরাই। সব বিষয়ে জ্ঞানী এবং বিষয়গত জ্ঞানী মানুষের সংখ্যা আদৌ কম নয়। তাই দেখা-জানা-পড়ারও কোনো বিকল্প নেই। দেখা, জানা ও পড়া একই সূত্রে বাঁধা। এবং মানবজীবনে এসবের গুরুত্ব অপরিসীম।

আমরা আমাদের শৈশব ও কৈশোরে অজানাকে জানার, দেখার এবং পড়ার আগ্রহতেই বেশি ব্যস্ত থাকতাম। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে রহস্যগল্প এবং বিজ্ঞানের কল্পকাহিনি ছিল প্রধান আকর্ষণ। আমাদের সময় ঢাকা এবং কলকাতা থেকে প্রচুর রহস্য গ্রন্থ এবং শিশু ম্যাগাজিন কুমিল্লায় আসত। বইয়ের দোকানে তো পাওয়া যেতই, গ্রন্থাগার থেকেও বাবা-মা এনে দিতেন। সেসব গোগ্রাসে পাঠ করা ছিল অপ্রতিরোধ্য অভ্যেস। বিদ্যালয়ে শিক্ষক, শিক্ষয়িত্রীরাও বলতেন নানা অজানা ইতিহাস। বাসা-বাড়িতে বাবা, মা ও দাদু-দাদারা পৃথিবীর রহস্য এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের গল্প শোনাতেন। আরও একটি মাধ্যম ছিল অদম্য জানাকে নিবৃত্ত করার জন্য তা হলো, বেশ কয়েকটি বিজ্ঞানভিত্তিক ম্যাগাজিন, যা ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতো।

স্বাধীনতার পরও কয়েক বছর ছিল ম্যাগাজিনগুলো, তারপর সব হারিয়ে গেল। হারিয়ে গেছে অনেক কিছুই। কাজেই এখনকার শিশু-কিশোর-কিশোরীরা যে অজানাকে জানার বা দেখার সুযোগ থেকে বহুগুণে বঞ্চিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৭৫ সালের পর থেকে ধর্মীয় শিক্ষাকে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হচ্ছিল তা অনেক সচেতন মানুষকেই চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছিল। সাম্প্রতিককালে ধর্মীয় শিক্ষার ঝোঁক যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তা আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আশাব্যঞ্জক নয়। দেশ উন্নত হলেও জাতি উন্নত হয় না এটা বোঝার সময় এসেছে বাংলাদেশের। সেই অনুযায়ী জাতীয় পরিকল্পনায় আধুনিক শিক্ষাকে সৃজনশীল কাঠামোতে না আনলে অদূর ভবিষ্যতে জাতির উন্নত বর্বর হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষা থাকবে না তা বলছি না, কিন্তু বেঁচে থাকার নিমিত্তে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের বিকল্প নেই। তাই বিজ্ঞানচর্চা একান্তই জরুরি। উদ্ভাবন ছাড়া গত্যন্তর নেই।

এই চিন্তা থেকেই আমি ২০০৭ সালে “কিশোরচিত্র” নামে একটি মাসিক ট্যাবলয়েড সংবাদপত্র প্রকাশ শুরু করেছিলাম কুমিল্লায়। এই কাগজটি প্রধানত শিশু-কিশোর-কিশোরীদের চিন্তাপ্রসূত মাতৃভাষায় লেখালেখি ও চিত্রাঙ্কনেরই একটি মুখপত্র ছিল। (এই বিষয়ে আরেকদিন লেখব।) যখন পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়, তখন কুমিল্লার জিলা স্কুল প্রাঙ্গণে কী একটা মেলা শুরু হয়েছিল। আমি সেখানে অংশগ্রহণ করি কিশোরচিত্রর একটি স্টল নিয়ে। প্রদর্শনী করি “হিরোশিমা” কিছু ছবি দিয়ে। ছবিগুলো আমি জাপান থেকেই কালার কপিয়ার মেশিনে বড় আকারে প্রিন্ট করে নিয়ে গিয়েছিলাম। আরও অন্যান্য বিষয়েরও অনেক ছবি ও দলিলপত্র নিয়ে গিয়েছিলাম একটি বড় সুটকেস ভর্তি করে। প্রচুর টাকা খরচ হয়েছিল বহন করে নিতে। আমার কাগজ “মানচিত্র” নিয়েও একটি প্রদর্শনী করার ইচ্ছে ছিল। পারমাণবিক বোমায় বিধ্বস্ত হিরোশিমা শহরের কিছু আলোকচিত্র দেখে ছাত্র-ছাত্রীরা অভিভূত হয়ে গিয়েছিল! অনেকেই বিস্ফােরিত বোমার আগুন, তেজষ্ক্রিয়তায় জ্বলেপুড়ে যাওয়া মানুষের দেহ, ভবন ও ধাতব জিনিস সামগ্রীর বিকৃত অবয়ব দেখে অবিশ্বাস্য মুখ করে আমাকে ঘিরে ধরেছিল এবং একাধিক প্রশ্ন করেছিল। আমি অবাক হয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, ছাত্র-ছাত্রীরা হিরোশিমা সম্পর্কে কিছুই জানে না! দেখেনি কখনো ধ্বংসের ছবিও! আমার ছাত্রজীবনে হিরোশিমার ধ্বংসের কথা জানা থাকলেও তা পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে ছিল না। তার মানে, বাংলাদেশ ১৯৭১-২০০৭ এই ৩৬ বছরে কতটুকু অগ্রসর হলো-তা বুঝার সময় এসেছে। বিশ্বজুড়ে পরিবর্তনের যে কী তোলপাড় হচ্ছে তার ঢেউ এসে লাগেনি এখনো আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে!

এরপর ২০১২ সালে অর্থাৎ ৫ বছর পর আমি আবার একই বিষয়ের দুটি প্রদর্শনীর আয়োজন করি, একটি কুমিল্লা টাউন হল মিলনায়তনের বারান্দায়। অন্যটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে অবস্থিত শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত চত্বরে। বিষয়: জাপানে রবীন্দ্রনাথ। ২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবর্ষ ছিল। এই উপলক্ষে জাপানে গৃহীত রবীন্দ্রনাথের দুর্লভ ৩০টির বেশি আলোকচিত্রর একটি প্রদর্শনী করেছিলাম টোকিও তাকানাওয়া প্রিন্স হোটেলে “জাপান-ইন্ডিয়া গ্লোবাল পার্টনারশিপ সামিট-২০১১”-এ তিন দিনব্যাপী। ব্যাপক সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। সেই ছবিগুলো বাংলাদেশে নিয়ে গিয়েছিলাম সঙ্গে করে। আমার বাবার বন্ধু এবং কিশোরচিত্র পত্রিকার মান্যবর উপদেষ্টা ঠাকুর জিয়াউদ্দিন আহমদ তথা জিয়াকাকার অনুরোধে কুমিল্লা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উক্ত আলোকচিত্রর প্রর্দশনী করেছিলাম। দারুণ সমাদৃত হয়েছিল দুটি প্রদর্শনীই। কারণ রবীন্দ্রনাথের ওপর এমন প্রদর্শনী এই দুই শহরে ছিল সর্বপ্রথম।

দুটি প্রদর্শনীতেই প্রচুর লোকের সমাগম লক্ষ্য করেছি। বিশেষ করে, কিশোর-কিশোরী এবং তরুণদের চোখেমুখে ছিল অজানা, অদেখাকে জানার প্রবল আগ্রহ। খুঁটিয়ে দেখছিল অনেক তরুণ। কেউ কেউ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করছিল নানা প্রশ্ন জাপান সম্পর্কে, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে। কত কৌতূহল তাদের! যে কৌতূহল আমাকে নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল একদিন জাপান-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্ককে জানার জন্য, ক্রমাগত অতলকে খুঁড়ে খুঁড়ে আবিষ্কার করার জন্য। প্রাচীন, পুরনো জিনিসই অজ্ঞাতদের কাছে নতুন বইকি। সেই নুতন জিনিসই তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম নিস্তরঙ্গ আমাদের সমাজে। কিছু কিশোর-কিশোরী-তরুণদের কৌতূহল মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। যে দেশ, রাষ্ট্র বা জাতি তার শিশু ও তরুণ প্রজন্মের সধ্যে কৌতূহল জাগাতে ও মেটাতে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না, সেই রাষ্ট্র বা জাতি সভ্যতা বহির্ভূত। অনেক ক্ষেত্রে পঙ্গু বলাই শ্রেয়।

জিয়া কাকাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই যে, এই দুটি প্রদর্শনীর আয়োজন না করলে আমি বুঝতে পারতাম না জগৎ সংসার থেকে বা প্রাচ্যের অতীত ইতিহাস থেকে আমাদের তরুণ প্রজন্ম কতখানি দূরবর্তী এবং কতখানি অজ্ঞ। আমাদের তরুণরা শুধু কবিতাই লেখে, সাংবাদিক হওয়ার জন্য অদম্য লড়ালড়ি তাদের কিন্তু বিজ্ঞানী হওয়ার দিকে ঝোঁক নেই, ইতিহাসবিদ হওয়ার দিকে কোনো আগ্রহ নেই, গবেষক, মননশীল প্রাবন্ধিক হওয়ার দিকে চেষ্টা নেই; সৃজনশীল ক্ষেত্রটি শূন্যই বলা যায়। আমরা জানি না, আমাদের শিশুদের কিসে আগ্রহ? তাদের সমস্যা কী? কী চায় তারা? কী হতে চায় তারা? তাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা বা স্বপ্ন সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, জানার চেষ্টা করি না। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজের দরজায় গেলেই রাজনীতির জালে তাদেরকে জড়িয়ে ফেলা হয়। যে রাজনীতি তরুণ প্রজন্মের আশীর্বাদ তো বয়ে আনেই না বরং অহেতুক রক্তক্ষয়ী আন্তঃকলহ, পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ এবং ভবিষ্যতহীনতার দিকে ঠেলে দেয়। যে রাজনীতি প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে, আবিষ্কার, উদ্ভাবনের দিকে, সৃজনশীলতার দিকে ধাবিত করে না। সে রাজনীতি প্রতিনিয়ত শেখায়, প্ররোচিত করে প্রকাশ্যে তরুণ প্রজন্মকে সমাজবিরোধী হতে, প্রগতিশীল কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও গবেষকদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু হতে, শিক্ষাবস্থায় দুর্নীতিগ্রস্ত হতে-এই ধারা চলছে বিগত ৫০ বছর ধরে। সভ্য-ভব্য আচার-আচরণ, রীতিনীতি, সম্ভাষণ, সম্মান প্রদর্শন, সম্ভ্রম সংরক্ষণ প্রবণতা এমন এক তলানিতে পৌঁছেছে যা রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য প্রবীণ সমাজকে লড়াই করতে হবে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। বিজ্ঞানমনস্ক, সৃজনশীল এবং দেশহিতৈষী শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

যেকোনো প্রদর্শনীতে শিশু-কিশোর-কিশোরী ও তরুণ প্রজন্মের কৌতূহল, জিজ্ঞাসা ও আগ্রহটাকে যেমন পরিমাপ করা যায় তেমনি, জাতিগত রুচিবোধটাও ধরা পড়ে।

টোকিও ২৮.৩.২০২১