মনা নিজেকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছে।এই ব্যাপারটায় সে একেবারে অপটু! সবসময় সাদামাটা জীবনযাপনেই অভ্যস্ত সে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কখনোই সেভাবে নিজেকে সাজিয়ে তোলার চেষ্টা সে করেনি। কিংবা কারোর পাশে নিজেকে মানাবে কিনা তা লিটারে-মিটারে মেপে দেখবার ইচ্ছে হয়নি।এর একটি কারণ হতে পারে, মনা এমনিতেই অপরূপা এবং স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যটুকুতেই সে দারুণ আত্মপ্রত্যয়ী! বাড়তি কোনোকিছু তাই ওর একদম পছন্দ নয়।তাছাড়া ওর ধ্যানজ্ঞানই ছবি আঁকা।ক্যানভাসে সৌন্দর্য চর্চাতেই ওর পরম তৃপ্তি!
কিন্তু আজ মনা ছকের বাইরে একটু উঁকি দিয়ে নিজেকে দেখতে এবং সাজিয়ে তুলতে বসে গেছে আয়নার সামনে।কারণ অবশেষে পূরণ দেখা করতে রাজি হয়েছে।অবশ্য সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল।
মনা অনুরোধ, অনুনয় এবং শেষে অভিমানের ছড়ি ঘুরিয়ে পূরণকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছে যে, তাদের প্রথম দেখা বিসিএস-এর প্রিলিমিনারী পরীক্ষার দিন হবে।
সেদিন মনার কথার মায়াজালে আটকা পড়ে পূরণ শেষে বলেছিল, শর্ত প্রযোজ্য!
কী শর্ত? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল মনা।
শর্ত হলো, প্রিলিমিনারী খুব ভালো দিতে হবে যাতে টিকে যাও।
ঠিকাছে, আমি রাজি।তবে প্রত্যেক প্ল্যান-এরই একটা অলটারনেটিভ প্ল্যান থাকা ভালো।যদি পরীক্ষা ভালো না দিতে পারি, তাহলে?
তখন পূরণ কঠোর কণ্ঠে বলেছিল, যে ব্যর্থ হবে তার জন্য শুভকামনা!
মনা বুঝতে পেরেছিল, সবই তাকে উসকে দিয়ে লক্ষ্য পূরণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠবার আহ্বান!
‘মহাশয় তো আজও একটা শর্ত দিয়েছেন’ ভেবে হাসল মনা। পূরণ সত্যিই ওকে একটা শর্ত দিয়েছে।সে আজ বিকেলে দেখা করবে মনার সাথে।তবে তাকে নীল শাড়ি পরে যেতে হবে!
শর্ত শুনে ঘাবড়ে গেছিল মনা।নীল শাড়ি সে কোথায় পাবে? সে তো এখানে কোনো শাড়ি আনেনি।সব গ্রামের বাড়িতে।তাহলে? অবশ্য উত্তর পেয়ে গেছে সাথে সাথেই।তারপর সে ছুটে গেছে নিচে।বাড়িঅলার স্ত্রী, লামের আম্মু, ওকে খুব স্নেহ করেন।তাঁর কাছ থেকে নীল শাড়ি আর ম্যাচিং করা অন্যসব জিনিসপত্রও পেয়ে গেছে সে।
আজিজ মাস্টার চত্বরের জে-মার্টের দিকে বেরিয়ে যাবার সময় মনাকে ওর পাশের রুমের মেয়েরা, এমনকি লামের আম্মুও বললেন, তোমাকে একদম অপরাজিতা ফুলের মতো লাগছে!
বুয়া ওকে দেখে হা হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।তারপর মুখটিপে হেসে বলল, মাশাল্লা! দেইখো কারো নজর য্যান না লাগে।
মনা জে-মার্টের দিকে এগোচ্ছে আর টের পাচ্ছে একটা শিহরণ খেলে যাচ্ছে ওর ভেতরে।অবশ্য একটা অস্বস্তি রয়েই গেছে, পূরণ তার সাথে একজন বন্ধুকে আনবে! কেন? সে একবার ভেবেছিল ঝুমাকে ডেকে নেবে, কিন্তু পরে সেই ভাবনা বাতিল করেছে।পূরণ তো তার অপরিচিত নয়। কেবলমাত্র দেখা করাটাই হয়ে ওঠেনি।
আচ্ছা, চর্মচক্ষুতে দেখাই কেবল দেখা, হৃদয়ের চোখে দেখাটা দেখা নয়?
অবশ্যই! মনে মনে এমন প্রশ্ন-উত্তর পর্ব চালিয়ে যেতে যেতে মনা পৌঁছে গেল জে-মার্টে।
এখানকার ছোট্ট ছোট্ট গোল গোল কুঁড়েঘরগুলো ওর খুব ভালো লাগে! পূরণ ফোনে জানিয়েছে পূর্বদিকের কাঁঠালগাছতলার গোল কুঁড়েঘরে সে অপেক্ষা করছে তার জন্য।
জে-মার্টের বড়ো রুমটা পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল মনা। তারপর ইট বিছানো রাস্তা দিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে চলল কাঁঠালতলার দিকে। গোল ঘরটির কাছাকাছি যেতেই চাটাই-এর বেড়ার আড়াল থেকে মুখ বাড়িয়ে একজন মনা-কে বলল, পাখি, শুভাগমন। কণ্ঠস্বরটি চিনতে পারল মনা।বুঝল ও-ই পূরণ।তাই নির্দ্বিধায় বিপরীত দিকের চেয়ারে বসতে বসতে সে বলল, অবশেষে মহাশয়ের মুখমণ্ডল দর্শন করা গেল! একটু যেন নড়ে উঠল পূরণের পাশে কালো রোদচশমা পরে পুতুলের মতো বসে থাকা ছেলেটা।বলল, আপনি এসেছেন!
মনার মনোযোগ পূরণের দিকে।স্বপ্নের অসম্পূর্ণ মানুষটি এখন সম্পূর্ণ অবয়ব নিয়ে তার সামনে বসে আছে।সুঠাম দেহ, ফর্সা গোলগাল মুখ এবং বোঝা যাচ্ছে বেশ লম্বাও।তবে মনাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করছে পূরণের চোখ! ছেলেদের চোখও এতটা সুন্দর হতে পারে ধারণা ছিল না ওর। আর মনার খুব চেনা চেনা লাগছে পূরণকে।যেন বহুবার মানুষটাকে দেখেছে সে! কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না, কোথায় দেখেছে।
ওয়েটার এগিয়ে আসছে দেখে পূরণ মনাকে বলল, তোমার পছন্দ অনুযায়ী অর্ডার কর।আমি কিছু খাব না, প্লিজ।আর ও আগেই আমাকে বলেছে তোমার পছন্দই ওর পছন্দ।
ওয়েটার ছেলেটা এসে মনার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে হা হয়ে কয়েক সেকেন্ড ওকে আর রোদ চশমাঅলা ছেলেটাকে দেখল।মনাকে না চিনলেও ছেলেটাকে সে ঠিকই চেনে।‘এই নীলপরি কানা রুকনের লগে এইহানে কী করে! তা-ও আবার বসছে কোণাকুণি হইয়া!’ মনে মনে ভাবল ছেলেটা। তারপরই নিজের দায়িত্ব মনে পড়ে যাওয়ায় হড়বড় করে জিজ্ঞেস করল, আপু অর্ডার প্লিজ।আমাদের এখানে কিন্তু ভালো ভালো…!
আসলে তেমন কিছু খাব না আমরা।হাতে সময়ও খুব বেশি নেই।দুটো লাচ্ছি দিন।সেপ্টেম্বরের শেষদিনও যা গরম গেল!
ওকে আপু, একটু বসুন প্লিজ।
ওয়েটার চলে গেলে পূরণ ইশারায় রুকন-কে দেখিয়ে বলল, ও রুকন, তোমাদের কলেজেই পড়ে।
ততক্ষণে ওকে চিনতে পারল মনা।রুকন ভাই, কেমন আছেন?
কে? রুকন জিজ্ঞেস করল।
আমি মনা, আপনার ক্লাসমেট শিমুর বান্ধবী।চিনতে পেরেছেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ মনা, ভালো আছো তুমি?
জি ভাইয়া।আপনার গানটা কিন্তু এখনো আমার কানে বাজে।সেই যে আপনাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সেমিনারে বসে শুনিয়েছিলেন, ‘ও মোর ময়না গো।’
চলবে..