হা হা হা। শব্দ করেই হাসল রুকন।মনা কিছুটা বিব্রতবোধ করছে। কারণ পাশের গোল কুঁড়েঘরগুলো থেকে অনেকেই তাকিয়ে আছে।সে নিজেকে মনে মনে ধমকে দিল, ‘কেন তুই ও মোর ময়না গো’ গানটার কথা ওকে বলতে গেলি? গাধা!
আর তক্ষুণি ওর মনে পড়ে গেল পূরণ দেখতে অবিকল ময়নামতির স্বামী মানে বড়ো খান সাহেবের মতো! ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের পরপরই ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে তোলা তাঁর সাদাকালো ছবি সে দেখেছে তাদের পারিবারিক অ্যালবামে।মনা অবাক চোখে পূরণের দিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে, দুটো মানুষের মধ্যে এত মিল! তা-ও আবার অর্ধশত বছর আগে-পরের দুটো মানুষের মধ্যে! আচ্ছা, এই মিলের মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই তো?
ওয়েটার ছেলেটা লাচ্ছি এনে টেবিলে দিয়ে গেল।পূরণকে কিছুটা বিচলিত দেখাচ্ছে। সে বারবার পশ্চিমাকাশে তাকিয়ে কী যেন দেখছে।ব্যাপারটা মনার দৃষ্টি না এড়ালেও সে কিছু বলল না। সে ভাবছে দুটো মানুষের মধ্যে মিলের কথা।এখানকার লাচ্ছির স্বাদ এবং সেই বিষয়ে মজার একটি গল্প বলছে অন্ধ রুকন। সে বুঝতে পারছে না মনার এতটুকুও মনোযোগ নেই ওর গল্পে। তবু সে তাড়িয়ে তাড়িয়ে লাচ্ছির স্বাদ আস্বাদন করছে আর বকে যাচ্ছে।
পশ্চিমাকাশের গা ঘষটে ঘষটে জেলা পরিষদ ভবন এবং বঙ্গবন্ধু স্কুলের ফাঁক গলে নেমে যাচ্ছে লাল সূর্যটা।পূরণের দুশ্চিন্তার কারণ ওই সূর্যটাই। সময় যে আর খুব বেশি নেই!
আরেকটা জিনিসে বারবার দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে মনার।পূরণ ও রুকনের চেয়ারের ফাঁকে ভাঁজ করা একটি অ্যাডাল্ট ওয়াকার দাঁড় করানো! ওটা কার? কেউ ভুল করে রেখে গেছে? তা কি করে হয়? কেউ তো আর ভুল করে তার ওয়াকার রেখে দিব্যি হেঁটে চলে যাবে না! তাহলে ওটা ওখানে কেন? সে রুকনকে ভালো করে চেনে।ও অন্ধ, কিন্তু ওর পায়ে তো কোনো সমস্যা নেই।
মনাকে বারবার ওয়াকারের দিকে তাকাতে দেখে দ্রুত বিদায়ের প্রসঙ্গ টেনে আনল পূরণ।বলল, মাগরিবের সময় হয়ে আসছে, এবার তো উঠতে হয় পাখি।
মনা-ও তাতে সায় দিল।আচ্ছা জনাব, চলুন উঠি।
রুকন হঠাৎ বলে ফেলল, ঠিকাছে এগোও, আমি আরও কিছুক্ষণ বসি।
মনা দাঁড়িয়ে গেছে এবং বিস্ফারিত চোখে দেখছে পূরণ টেবিলে ভর দিয়ে খুব কষ্টে উঠে দাঁড়াচ্ছে! সে খুব সাবধানে দুই চেয়ারের মাঝখান থেকে ওয়াকারটি বের করল, আর ওর পা দুটো যেন দুমড়ে মুচড়ে যেতে চাইছে! সাথে সাথে দুলে উঠল মনার পৃথিবী এবং টাল সামলাতে না পেরে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল!
মুহূর্তেই শোরগোল পড়ে গেল জে-মার্টের উঠোনে।আশেপাশের সব গোল কুঁড়েঘর থেকে একে একে সবাই জড়ো হলো কাঁঠালতলায়।ছুটে এল কয়েকজন ওয়েটার এবং ম্যানেজার।
রুকন ক্রমাগত প্রশ্ন করছে, কী হয়েছে? কে পড়ে গেছে? হ্যালো ভাই, কেউ বলবেন কী হয়েছে?
কেউ ওর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না।ম্যানেজার উল্টো ওকেই ধমকের সুরে প্রশ্ন করল, আপনার সামনে মেয়েটা কীভাবে পড়ে গেল?
রুকন তোতলানো শুরু করল, কী কী কী ব-অ-লেন এইসব!
একজন ওয়েটার এগিয়ে এসে ওকে সেভ করল, ওনার কোনো দোষ নেই স্যার।আমি ওখান থেকে দেখেছি ম্যাডাম একা একাই পড়ে গেছেন। রুকন ভাই ওখানেই বসে ছিলেন।ততক্ষণে মনার মেসের তিনজন মেয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করছে ওর জ্ঞান ফিরিয়ে আনবার জন্য।মনাকে না জানিয়ে ওরা চুপিচুপি এখানে এসেছিল ওর স্বপ্নপুরুষকে আড়াল থেকে দেখে চলে যেতে! ওরা যখনই জে-মার্টের উঠোনে নেমেছে তখনই মনা ধপাস! তক্ষুণি তিনজন ছুটে এসেছে মনার কাছে।
চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিলে জ্ঞান ফিরল মনার। চোখ খুলে সে বোকার মতো এদিক সেদিক তাকিয়ে ওর মেসের মেয়েটার কোল থেকে মাথা তুলে বসল।তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রশ্ন করল, উনি কোথায়? বড়ো খান সাহেব?
কে বড়ো খান সাহেব?
তুমি কার কথা জিজ্ঞেস করছ আপু?
এখানে রুকন ভাই ছাড়া তো আর কেউ ছিলেন না!
খলবল করে কথাগুলো বলল মনার মেসের মেয়েরা।আরও একবার চোখ ঘুরিয়ে জড়ো হওয়া সবাইকে দেখে মনা ক্লান্ত গলায় বলল, আমাকে বাসায় নিয়ে চল্।খুব ঘুম পাচ্ছে।
কথাগুলো বলে একটা মেয়ের কাঁধে মাথা রেখে সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ল সে!
ওদের পেছন থেকে রুকন তখনো প্রশ্ন করছে, ভাই, কী হয়েছে?
ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা কিছুটা রাগত স্বরে উত্তর দিল, আরে ভাই, আপনার সামনে বসে ছিল যে মেয়েটা সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেছিল মাটিতে।আর এখন জ্ঞান ফিরে এলেও আবোল তাবোল বকছে!
মনা! ওর নাম মনা।হঠাৎ জ্ঞান হারাল কেন?
লোকটা রুকনের এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ওর সামনে থেকে সরে গেল।
মনা যখন চোখ খুলল তখন রাত ঠিক কতটা গভীর সে বুঝতে পারল না।দেখল, রুমে হালকা আলোর বাতিটা জ্বলছে আর ওর পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছে পূর্বদিকের শেষ রুমের শান্তা।সময় দেখবে বলে পাশ ফিরে মোবাইলটা খুঁজতে গিয়ে ও স্পষ্ট দেখল রুমের দরজা হাট করে খোলা আর ওয়াকারে ভর দিয়ে একজন মানুষ বেরিয়ে যাচ্ছেন! আশ্চর্য! ও একটুও ভয় পেল না।বরং কৌতূহলী হয়ে উঠল, কে বেরিয়ে গেল? পূরণ? নাকি বাবার দাদা মশাই মানে বড়ো খান সাহেব?
নিজের মনে করা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সে উঠে নির্দ্বিধায় মানুষটার পিছু নিল এবং একটু পরই নিজেকে ছাদে দেখতে পেল! আকাশে তখন হালকা কুয়াশার আড়াল থেকে আবছা জোছনা ঢালছে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ।
চলবে