ভাষান্তর: মঈনুস সুলতান
ভূমিকা: আফগানিস্তানের হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষজন নানাভাবে নিগৃহীত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। ঐতিহাসিক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী- ত্রয়োদশ শতক থেকে এ সংখ্যলঘু সম্প্রদায়ের ওপর চলছে মূলধারার জনগোষ্ঠী কতৃক নিপীড়ন। ধর্মবিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে হাজারা-মুসলিমরা শিয়া মাজহাবের অনুসারী; সে কারণে তাদের বিরুদ্ধে একাধিক বার পরিচালিত হয়েছে অনায্য যুদ্ধ; বিতাড়ন করা হয়েছে বসতবাড়ি থেকে, কেড়ে নেওয়া হয়েছে ভূসম্পত্তি। খোলা বাজারে হাজারা নারী-পুরুষকে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনাও বিরল নয়।
এ নিপীড়ন প্রক্রিয়ায় গেল তিন দশক ধরে যুক্ত হয়েছে তালেবানদের নেতৃত্বে ধর্মযুদ্ধ। তারা ক্ষমতাসীন হওয়ামাত্র অজস্র হাজারা পরিবার পাকিস্তান ও ইরানে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়। এ প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিলো কিশোরী কবি শুকরিয়া রেজাইও। প্রথমে তার পিতা দেশত্যাগে বাধ্য হন, সামান্যদিন পরে বাস্তুভিটা ত্যাগ করে শুকরিয়া তার মা-কে নিয়ে এসে হাজির হয় পাকিস্তানের রেফ্যুজি ক্যাম্পে।বর্তমানে তেইশ বছর বয়স্ক তরুণী শুকরিয়া রেজাই বসবাস করছে ইংল্যান্ডে। যেখানে পিতার সঙ্গেও তার পুনর্মিলন হয়েছে।
পনেরো বছর বয়সে কিশোরি শুকরিয়া তার কাব্যকীর্তির জন্য সাহিত্য পুরষ্কারে ভূষিত হয়। ইংল্যান্ডের ফরোয়ার্ড আর্টস ফাউন্ডেশন সম্প্রতি তাকে শিক্ষানবীস হিসাবে কাজ করার সুয়োগ দিয়েছে।ইংরেজি থেকে ভাষান্তরিত চারটি কবিতা, কবির বায়ো-বিষয়ক তথ্য ও কবির আলোকচিত্র প্রভৃতির সূত্র ইন্টারনেটের একাধিক ওয়েবসাইট। কবিতাগুলোর নিচে যে বয়সে শুকরিয়া তার ভাবনাকে পদাবলীতে রূপান্তরিত করেছিল, তাও উল্লেখিত হলো।
পারি না লিখতে
হাজারা সম্প্রদায়ের মানষজনকে নিয়ে আমি পারি না লিখতে —
যুগ যুগ ধরে যারা ভুগেছে দুঃখ কষ্ট ও যন্ত্রণায়
তাদের নিজস্ব স্বদেশ আফগানিস্তানের পাহাড় প্রান্তর ও উপত্যকায়;
হয়েছে শরণার্থী পাকিস্তানে—
কিন্তু পারেনি বসবাস করতে শান্তিতে
চোখের সামনে খুন হয়েছে তাদের স্বজন;
কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছে ইরানে—
কাজুবাদামের মতো চোখের আকৃতির কারণে
ওখানেও লাঞ্চিত হয়েছে তারা,
না, তাদের নিয়ে কিছুই লিখতে পারি না আমি
নীরবে শূন্য হয়ে ওঠে আমার মন!
আমার বসতবাড়ির পাশে কী ভয়ংকর আওয়াজে বিষ্ফোরিত হয়েছিল গোলা
কীভাবে সংজ্ঞাহীন হয়ে লুঠিয়ে পড়েছিলেন আমার খালা—
আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে কী রকম আমার মা এর হাতে ধরা পেয়ালাটি
ফস্কে পড়ে ভেঙেচুরে হয়েছিল খান খান—
এসব নিয়েও পারি না কিছু লিখতে আমি।
মৃত্যু হয়েছে চোখের সামনে নিরপরাধ মানুষের
কীভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে ক্রমশ শহীদানের গোরস্থান,
কী নিদারুণ যন্ত্রণায় কেটেছে আমার আপনজনের দিনকাল,
বিশ্ব কীরকম থেকেছে নির্লিপ্ত নিরাবেগে নির্মম —
এসব কিছুই ফুটে না আমার মতো বালক বালিকাদের লেখনীতে।
•পনেরো বছর বয়সে শুকরিয়া কবিতাটি রচনা করেন।
চা এর গেলাস
গেল বছর— একটি চা এর গেলাসকে আমি তুলে ধরেছিলাম সূর্যালোকে
আর এ বছর ঘূর্ণচক্রে উড়ছি আমি অক্সফোর্ড স্ট্রীটে,
একটি বছর আগে আমার চোখজুড়ে ছিলো নির্মল নীলাকাশ—
আর এ বছর ঘুরছি আমি বর্ণহীন মেঘমালার নিচে;
গেল বছর দেখেছি ঝলমলে সূর্যের মাহিমাময় নৃত্য,
আর এ বছর ম্রিয়মান এ সুরুষ গড়িয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যৎবিহীন।
অভিবাসন উড়িয়ে এনেছে আমাকে এ বন্ধুর পথে —
যেখানে মুখ থুবড়ে পড়ে আমি শুঁকেছি মৃত্তিকা,
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছি আকাশ ছাওয়া মেঘ।
এখন মনে হচ্ছে—নিজেই হয়ে উঠেছি একটি পাখি
উড়ছি হাওয়ায় ক্রমাগত আর হরিয়ে যাচ্ছি অজানা এক বিশ্বে;
স্মরণীর মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে পড়ে আমাকে করো না তো কোন প্রশ্ন,
পারো তো তাকাও আমার চোখের দিকে আর অনুভব করো আমার হৎপিণ্ড;
আঘাতপ্রাপ্ত এ চোখে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রদাহ
আমার চোখ দুটিতে পরানো হয়েছে পেঁয়াজের খোসা দিয়ে তৈরি নেকাব।
বসে আছি ভাঙাচোরা নীড়ে অসহায়,
জানি না কীভাবে মেরামত করবো,
আর আমার হৃদয়,
বলা চলে—একটি আশ্রয়ে সন্ধানে হয়েছে স্থানচ্যূত।
• সতেরো বছর বয়সে শুকরিয়া কবিতাটি রচনা করেন।
পর্যবেক্ষণ
দ্যাখো—তৃষিত শোণিত জমাট বেঁধে কীভাবে ছড়িয়েছে বাতাসে
কীরকম অনায়াসে মাংশ-মজ্জা বিষ্ফোরিত হয়ে ছড়িয়েছে সর্বত্র।
চেয়ে দ্যাখো—মেঘস্পর্শহীন মৃত্তিকায় কীভাবে ঝরে পড়েছে লোহিত রক্ত
হয়েছে বাতাসের অণূপরমাণু শেষ নিঃশ্বাস।
দ্যাখো—কীভাবে মানুষের জোড়া চোখ খুঁজে ফিরছে প্রিয়জন।
কীরকম নিঃশঙ্ক তারা—কী নিষ্ঠায় করছে প্রতীক্ষা সঠিক সংবাদের—
খেয়াল করে দ্যাখো—কীরকম উচ্চরোলে বাজছে অ্যাম্ভূল্যান্সের সাইরেন,
কীভাবে তুমি তাকিয়ে আছো শূন্যতায়— নয়নে তোমার জমে ওঠে অশ্রু-বলয়।
• সতেরো বছর বয়সে শুকরিয়া কবিতাটি রচনা করেন।
চাই একটি কবিতা
চাই একটি কবিতা আমি
সন্দেশের ওপর চিনির গুড়ো ছড়ানো চালুনি মতো হবে
যার বুনট।
পদাবলীর সন্দেশটি হবে দারুচিনি ও এলাচের মশল্লায়
এতোই সমৃদ্ধ যে—
আংগুলে অগ্রভাগে লেগে থাকবে তার সুমিষ্ঠ সারোৎসার।
চাই এমন একটি কবিতা
কড়াইয়ের তপ্ত তেলে সন্দেশটি ছাড়া মাত্র
চিড়বিড়িয়ে ওঠবে তা।
পেস্তা-বাদাম-কিশমিশের জেওরাতে সজ্জিত
কবিতাটি রূপার তিরলে করে উপস্থাপিত হবে
ফরাশ ঢাকা জাজিমে বসা মেহমানদের সামনে।
কবিতাটি হবে ঈদের উৎসবে
জাফরান মেশানো চনমনে চা এর মতো।
অতিস্বচ্ছ হরফবিহীন শূন্য কাগজের বুনটে তৈরি হোক কবিতাটি
তা দেখতে হবে—আলো বিচ্ছুরিত স্ফটিক-প্রিজমের মতো।
প্রতিটি বর্ণের সুনির্দিষ্ট দ্যুতি পর্যবেক্ষণের আগে
ছেড়ো না তো হাল।
• আঠার বছর বয়সে শুকরিয়া কবিতাটি রচনা করেন।