নির্বাচিত দশ কবিতা ॥ সৈয়দা আইরিন জামান


ছবি: লংরিড

পুঁজিবাদী প্রেম

তোমার লেখা চিঠি
এসেছে চাঁদের খামে শরতের ভোরে
কাশফুলের নকশার কলতানে
স্মৃতির দেয়ালে ঠেস দিয়ে ভাবি, তুমি আজ কই?

রোদেলা দুপুরে এলোচুল তো ছিলো খোলা-পাওনি সৌরভ
ভেনাসের অন্তর্জালে শোননি প্রেমের রাগিণী
অতীতের কথা কিছুই বলেনি বিস্তৃত বাতাস
উচ্চকিত ভালবাসা উস্কে দেয়নি কিউপিড?

জানি, পুঁজিবাদী বিশ্বে প্রেমিকও হয়ে যায় গুম
অবসাদের ইমোজিতে শুধুই প্রতীক্ষারা থাকে জেগে
তবু বলি-ফিরে এসো-ফেরো-প্রেমের প্রান্তরে
বিটকয়েনের হিসেব কেন কাশবনে নয়?

কতিপয় শেয়াল ও অসংখ্য পাচারকারি

দুটি ডিম পোজ আর পেঁপের সেস্কি
সঙ্গে দুতিনটি রুটি খেয়ে পিতা কোর্টে
যেতেন চায়না ফনিক্স সাইকেলে চড়ে

এরপর মুরগির ঘর খোলা হতো মায়ের নির্দেশে
গৃহপালিত এসব প্রাণী গৃহস্থের পুষ্টির উৎস
যথেষ্ট জ্বর তখন টাকার শরীরে
ডলার দূরবর্তী গ্রহ কিংবা স্বপ্নের সওদাগর
সুযোগ পেলেই শেয়ালেরা মুরগি ধরে
পেছনের জঙ্গলে চলে যেতো
এই নিয়ে অস্থিরতা ভীষণ প্রকট
প্রতিদিন কমপক্ষে একটি মুরগি হতো অপসৃত
সারগর্ভ আলোচনা চলতো সন্ধ্যায়
শেয়ালেরা দাঁড়াতো পলাতক আসামির কাঠগড়ায়

আজকাল মানুষের চরম অধপতনে
শেয়ালদের মাথা ক্রমশ উঁচু হচ্ছে
ওরা লোপাট করেছিলো কয়টি মুরগি
৫০, ১০০, ২০০, ১০০০?

তাতেই মানুষের দাবড়ানিতে শেয়ালেরা মৃত্যুর সীমান্তে পৌঁছাতো
আর ডিজিটাল নাগরিক এক বছরেই
৭৩ হাজার কোটি টাকা করে দেয় পাচার
অথচ এদের কেউ ধাওয়া দেয় না-করে না বয়কট
এমনকী অপ্রকাশ্য এদের নামও
আর-আর-আর
ক্ষমতার মগডালে দোল খায় তাঁরা !!!

জাগতিক কিংবা অবমুক্তিক ঘুম

ঘুম ছিলো আতাফুলের গন্ধে
ঘুম ছিলো শিশির মাঠের দিগন্ত বিস্তৃত নিস্তব্ধতায়
দাঁতছোলার রসালো ফলে, ডুমুরের ডালে
ঘুম ছিলো বৌভুলানো আম গাছের তলে
ঘুম ছিলো হলদে বৌয়ের ডানায়
ঘুম ছিলো দুর্বাঘাসের ডগায়
ঘুম ছিলো শালুকের ফলে
ঘুম ছিলো মায়ের উনুনের পাশে
ঘুম ছিলো পিতার হারিকেন জ্বালিয়ে বই পড়ায়
ঘুম ছিলো ভায়ের সাইকেলের প্যাডেলে
ঘুম ছিলো বোনের কাপড় কাঁচায়
ঘুম ছিলো জোছনা রাতের আড্ডায়
ঘুম ছিলো আমার শৈশব জুড়ে
ঘুম ছিলো আমার কৈশোর জুড়ে
ঘুম ছিলো আমার যৌবন জুড়ে
ভাতঘুম
সাঝঘুম
রাতঘুম
একটা না একটা আকাঠা বাঁধিয়ে
তোমরা ঘুমাতে দাওনি আমায়-
অন্তহীন ঘুম-সেতো ঘুম নয়, অনন্ত জাগরণ!

পিতার অন্তর্ধানে

দিগভ্রান্তের আঘাতে শোণিত সমুদ্র
প্রাণহীন পিতা পড়ে আছেন সিঁড়িতে
পিতার নিথর দেহ-সিঁড়িতে সিঁড়িতে

নর্দমার কীট ওরা, নিকৃষ্ট হার্মাদ
নরকের সহোদর সীমারের দল

পিতা কবরে শায়িত-আমি ঝুলে আছি
বাতাসের আঙটায়-তবু বেয়ে যাই তরী
পিতার অন্তর্ধানে বুকটা আমার হু হু করে
হু হু করে–হু হু করে—হু হু করে
সময়ের ঠোঁটে সব ক্ষত আছে জমা
হাওয়ার ওড়নায় ধ্বনিত আমার আর্তনাদ
আমি তো ছিলাম বাবার লক্ষ্মী সোনা মেয়ে

বুকের হাপরে বাস করে সেই এক পিতা:
অহর্নিশ প্রমত্তা নদী-জলপ্রপাতের ধারা
সঞ্চরণশীল জলের মূর্ছনা অনুষ্টুপ ছন্দে

একটি উড়ন্ত পাখি তারস্বরে ডেকে
আমাকে পিতার কোলে বসিয়ে কেমন
চলে গেছে আনমনে সহজ সরল
হায়, সুবর্ণ অতীত-এতো ব্যথা কেন?
এতো ব্যথা-এতো ব্যথা-এ্যাতো-এতো ব্যথা!

ছক্কার উৎসব

ভেবেছিলো অনেকেই পদক কিংবা পুরস্কারপ্রাপ্ত
লেখকের ওপরে
ভাইটাল পত্রিকাগুলো হামলে পড়বে
বাস্তবে ঘটেনি তেমন কিছু অথবা ঘটে না
তবে কী তারা জানেন না মানসম্পন্ন সাহিত্যের ব্যাকরণ
নিন্দুকেরা অবশ্য বলছেন তাই

অভিজাত সিঁড়িগুলো কেমন ফ্যাকাশে
মেরুদণ্ড সোজা কেউ আর হাঁটে না সেখানে
তাই, আইসো বন্ধু, বইসো বন্ধুদের আনাগোনা
পূর্বসূরি তো একটি বৃক্ষ বুনেই মেরেছেন ছক্কা
উত্তরসূরিও বেড়ে উঠছে অবারিত উচ্ছৃঙ্খল
আসুন-আমরা করতালি বাজাই

তীব্র বেপরোয়া তুমি, তবে কিলার আব্বাস নও

কী এমন অপরাধ তোমার
তুমি তো অস্ত্র বানাওনি
কখনও মুরগি মিলনের মতো অস্ত্র শানাও না
ষড়যন্ত্র করনি রাতের আঁধারে
যেমন করেছিলো দেবতারা-করে মানুষও
সেভেন মার্ডারের সঙ্গে যোগ নেই কোনও
গোল্ডেন মনিরের নাম শোননি তুমি
ফুসকা শামীমের সঙ্গে ফুসকা খাওনি কখনও
লেডি দাবাঙের সঙ্গে ছিলে না ওয়েস্টিনে
ঝুলন্ত পাড়ায় ঝুলে থাকোনি কখনও
বালুখেকো সেলিমের সঙ্গে গালগল্পে মাতোনি

কাউকে কথা দিয়ে রাখোনি কথা
এমনও নয়।এক্সপ্লয়েড করেছো কাউকে
না, তাও নয়। প্রতারণা-সেতো অজানা তোমার
এমন কী ধারণা নেই নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে
ধারণা নেই হোয়াইট রোজ কিংবা খাপড়া ওয়ার্ড সম্পর্কেও
‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ শোননি গানটিও

বিমান বালাদের সঙ্গে সখ্য না গড়েই করলে পৃথিবী ভ্রমণ
আবার বিমান বন্দরকে দিলে শতাব্দী প্রাচীন
ক্লান্তির বেদনা থেকে অবসর

মানুষের ফুসফুসে গড়েছো আবাস
নিত্য নবতর সংস্করণ তোমার
ক্ষমতা কিংবা বিত্ত কোনটিই নয় লক্ষ্য
তবুও কিলার আব্বাসের মতো বেপরোয়া তুমি
ভালবেসেছো মানুষকে-এর নাম কী ভালবাসা?

সুখ্যাতি নিজেই এক ধ্রুপদী পতাকা

বিষয়টি অনিবার্য ছিলো-সতর্কতা সর্বোচ্চ
ঘটনাটি ঘটলই-নিয়তির ধারা
চূড়ায় ওঠার আগে খাড়ির দূরত্ব মাপিনি
যদিও আমরা মুখোমুখি ভাবছিলাম জন গলস্ওরদির কথা
কিছু স্যাঁতসেঁতে দেয়াল রৌদ্রের ব্যাকুলতায় কাতর
কয়েকটা শয়তান ছিলো ছায়াসঙ্গী
হায়েনা আর শেয়াল সুযোগের সন্ধানে
সঙ্গে কাকের দলও-যেমন ভাত ছেটানো হয় আর কী!

একদা মঞ্চে এলেন ঘোড়েল
সেটিই তার জন্মগত স্বভাব
ঘোড়েলের অধপাতে দেউল শুধুই উঁচু হয়
আর
সুখ্যাতি নিজেই এক ধ্রুপদী পতাকা!

শূন্যতার সূত্র

সন্ত, ফেরার সময় হলো ফিরে যাও
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনারা গেছে ফিরে
যেমন প্রস্থান ছিলো ভিয়েতনাম থেকে
পশ্চিমা পাপের সত্যধ্যানে দ্বিধান্বিত তালেবান
পাকিস্তানের সঙ্গে হলো শেষ মধুচন্দ্রিমা

বরাদ্দ অতি সামান্য-যদিও ব্যাংকে
অলস অর্থের স্তুপ-আহত সময়ে
আলতামিরা গুহায় হতে পারো ধ্যানে মগ্ন
যখন জেনেই গেছো শূন্যতার সূত্র
পেগাসাস থেকে দূরে যাও-বহু দূরে
কথা বলবে-না না-কোনো কথা নয়

সন্ধ্যার বেহাগ

এমন নিথর শহর তো চাইনি
বিষণ্ন বেদনায় বিদীর্ণ
দুপুরের আলোয় নামে সন্ধ্যার বেহাগ
রঙ্গনে নেই জীবনের রং-
মৃত্যুর প্রবল ছায়া বিলোল বাতাসে
বেহায়া চাঁদ হাসে কেবল উপহাসে
লোকালয়ের উচ্ছ্বাস নিভে গিয়ে
গ্রেভইয়ার্ডের আলো জ্বলে উঠেছে
এ কেমন উৎসব !!

ঘাসফুল

পতঞ্জলি আর নাও আসতে পারে
তার ফেরার পথে রেড এলার্ট
সময়টাকে ভাজ করে গেছে পরটার ভাজে
স্পন্দিত জীবন এখন কথা কয় কেঁদে কেঁদে
কত ব্যথা বুকে তাঁর সেই শুধু জানে
আর জানে তার প্রেম-
জানে আষাঢ়ের মেঘ, মগডালের একাকী
পাখি, চরপড়া নদী, বিষণ্ন বিকেল আর ঘাসফুল!