সাদা বালির সৈকত ॥ মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ


“Some 16km out of Freetown’s dust and noise is a piece of unexpected paradise. River Number Two beach” — The Guardian.

২০০২ সালের কাহিনি। স্থান- পশ্চিম আফ্রিকার আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলবর্তী সিয়েরা লিওন। গুমা ভ্যালী বাঁধ থেকে আঁকাবাঁকা ঢালু পথ দিয়ে অবতরণের পর আমরা পেনিনসুলার রোডে ফিরে এলাম। মোশাররফ গাড়ি চালাচ্ছে। মোরশেদ আর আমি গাড়ির পেছনের সিটে। রাস্তার বামদিকে সিংহ পর্বতের সারি। সমুদ্রের সমান্তরালে দক্ষিণ পুর্ব দিকে চলে গেছে। পুরো রাস্তাটাই ধূলিধূসরিত। লালচে ধূসর রঙের। ধূলার কারণে সামনের রাস্তাকে কুয়াশার মতো অস্পষ্ট মনে হচ্ছে, অথচ মাথার উপরে তীব্র রোদ। চোখ ঝলসে যাচ্ছে। রাস্তার ডানদিকে কিছুদূর পর পরই পাম গাছের ঘন সারি, আম গাছের বন, নাম না জানা গাছের দল। রাস্তা থেকে সাগরের অস্তিত্ব বোঝা যায় না। শুধু একটু পর পর গাছের ফাঁক দিয়ে চোখের ভেতরে রুপালী আলো ঝিলিক দিয়ে ওঠে। তখন বোঝা যায় যে, ডানেই সমুদ্র।

কিছুক্ষণ চলার পর মূল রাস্তা থেকে বের হয়ে ডানদিকে একটা ঘন বনের মতো জায়গা। বিশাল বিশাল গাছের ছায়ায় গাড়ি পার্কিং প্লেস। রাস্তার উল্টোদিকে একটা সাদা দেয়ালের পাশে কয়েকটা উন্মুক্ত জলের শাওয়ার। বাসার বাথরুমে যেমনটা থাকে। ভ্রমণকারীরা সৈকত থেকে উঠে আসার পর এখানে শরীরের লবণাক্ত জল ধুয়ে ফেলে। পার্কিং প্লেসের পাশেই কয়েকটা স্যুভেনিরের দোকান। ভেতরে কাঠের তৈরি বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য। সবগুলোই মেহগনি অথবা আবলুশ কাঠ দিয়ে তৈরি। এগুলোর শিল্পীরা সবাই এদেশের সাধারণ মানুষ। আমি একবার ফ্রিটাউনে এক যুবক শিল্পীর সাথে কথা বলেছিলাম। ১৯৯৮ সনে রিবেলরা তার একহাত কেটে ফেলে দিলে সে পূনর্বাসন কেন্দ্রে ছিল। এখন অন্য হাত দিয়েই সে লম্বা ছুরি দিয়ে নরম কাঠের উপরে কার্ভিং করে বিভিন্ন ভাস্কর্য তৈরী করে বাজারে বিক্রি করে। তার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই। পাহাড়ের গুহার দেয়ালে বিভিন্ন রঙের পাথর গুড়ো করে রঙ তৈরী করে প্রাণী বা প্রাণি শিকারের ছবি আঁকা মায়া সভ্যতার শিকারীদের মতো।

দোকানের বেশীর ভাগ স্থাপত্যই ঈগল পাখির। অদ্ভুত সব ভঙ্গীতে উড়ছে। অবশ্য আমি এই দেশে আসার পর এদের একটাকেও আকাশে উড়তে দেখিনি। তবে সাদা গলার অনেক কাক দেখেছি। সিয়েরালিওনের সর্বত্র এই ঈগল- মূর্তি পাওয়া যায়। আমার বিশ্বাস সিয়েরালিওনে জাতিসংঘ মিশন সম্পন্ন করা সকল বাংলাদেশী সেনাসদস্যদের প্রতিজনের বাসায় একটা করে ঈগল পাখির ভাস্কর্য থাকবে। পাশেই শরীরহীন কাঠের তৈরী একটা কালো মানুষের ভাস্কর্য। নাম ‘থিংকিং ম্যান’। পর্যটকদের কাছে খুবই প্রিয়। কাঠের কার্ভিং দিয়ে গড়া মানুষ, বই পড়ছে। নাম ‘Man reading’। পাশেই আবলুশ কাঠের তৈরী বিমূর্ত চেহারার যুবতী মেয়ে। পিঠে জলের পাত্র নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। অদ্ভুত সুন্দর ও বাঙময় ভঙ্গিতে। দোকানের দেয়ালের গায়ে বিভিন্ন ধরণের মুখোশ। সবই আফ্রিকার মানুষদের মুখ। অসাধারণ তাদের মুখের প্রকাশ। হিংসা, বেদনা বা আনন্দ সকল অনুভূতিই ফুটে উঠেছে। সবগুলোই অদ্ভুত ধরণের অলঙ্কার পরা।বন্য গণ্ডার অথবা হাতির ভাস্কর্যগুলো দেখে মনে হচ্ছিল এরা একটু পুর্বেই পর্বত আর সবুজে ঢাকা ওয়েস্টার্ন এরিয়া রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে এখানে চলে এসেছে। জল বা খাবারের সন্ধানে।

একটু দূরে পাহাড়ের গায়ের সরু রাস্তা দিয়ে পিঠে করে কাঠ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কালো মানুষেরা। অসাধারণ পেশীবহুল শরীর। গডরিচে আমাদের ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের নিকটেই মিল্টন মার্গাই স্কুল অফ এডুকেশন এন্ড টেকনোলোজির পাশে বিশাল টিলার পাশে প্রকান্ড একটা খেলার মাঠ। সেই মাঠে ঘাস নেই বললেই চলে। পুরো মাঠই কংকরময় ও পাথুরে। একদল কিশোর এই মাঠে সারাদিনমান ফুটবল খেলে খালি পায়ে। সূর্যের আলোতে তাদের শরীরের পেশীগুলো চকচক করতে থাকে।

অথচ এই দেশের মানুষেরা সারাদিনে মাত্র একবার প্রধান আহার করে থাকে। দিনের অন্য সময়ে প্রধানত বিস্কুট বা হালকা ধরণের কিছু খেয়ে থাকে।

অবাক করা ব্যাপার হলো সমুদ্রের পাশে হলেও এই জায়গা থেকে সমুদ্র তেমন দেখা যায় না। রাস্তার পূব পাশেই কয়েকটা খাবারের রেস্টুরেন্ট। সেগুলোর ভেতর দিয়ে হেঁটে সমুদ্রের তীরে আসতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবার যোগাড়। বিশাল বিশাল পাম গাছের সারি। পাশে বিস্তৃত বালির সৈকত। ধবধবে সাদা। আমি জীবনে কোনদিনই একসাথে এত বিশাল প্রাকৃতিক শুভ্রতা দেখিনি। পামগাছগুলোর পাশে অনেকগুলো ছনের তৈরী গোলঘর। একসারিতে। সাগরে সাঁতার কাটার পর এগুলোর সামনে রাখা কাঠের বেঞ্চের উপরে শুয়ে রেস্ট নেয়া যায়।

এখন ভাটির সময়। সাগরের জল উপকূল থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। স্বচ্ছ জলের নীচে সমুদ্রের তলদেশ দেখা যাচ্ছে। সেটাও সাদা। বালি অতিক্রম করে সমুদ্রের ভেতরে হালকা নীল জল। মনে হচ্ছে অতিকায় এক তিমি মাছ জলের নীচে ভাসছে। একটু দূরেই রিভার-২ নদীর মোহনা। গুমা ভ্যালি থেকে এঁকেবেঁকে এই নদী সমুদ্রে এসে পড়েছে। মূল সমুদ্রে মিলে যাবার আগে পাকস্থলীর মত একটা ল্যাবিরন্থ তৈরী করেছে। এটা একটা লেগুন। জোয়ার আসার পূর্বে স্নানার্থীরা এই লেগুনেই সাঁতার কাটে। নিরাপত্তার কারণে।

সাগরের বেলাভূমিতে হাঁটার সময়ে আমার ভেতরে বিভিন্ন অনুভূতির সৃষ্টি হয়।একেক সময়ে একেক অনুভূতি। কখনও কখনও বেলাভূমির সাপেক্ষে মানুষের অনিত্যতা আমাকে কষ্ট দেয়। মনে হয় এই সৈকত এখন থেকে সহস্র বছর পূর্বেও একই রকম ছিল। কত মানুষ, কত প্রাণী এই সাগরের তীরে এসেছে। এর জলে অবগাহন করেছে। জল পান করেছে। এরা কেউই এখন আর নেই। একদিন আমিও থাকব না।

তবে এই সাদা বালির সৈকতের অনুভূতিটা অন্য ধরণের। ফ্রীটাউন থেকে একটু দূরের এই জায়গাটায় অদ্ভুত ধরণের একটা শান্তি বিরাজ করে।

আকাশে কোনো ধূলা নেই। পার্থিব কোন দুঃখ-বেদনা কখনই এই জায়গাকে স্পর্শ করেনি। এমনকি গৃহযুদ্ধ বা কোনো অরাজক অবস্থাই এই স্থানের শান্তিকে বিনষ্ট করতে পারেনি। প্রকৃতি এখানে মনের মাধুরী মিশিয়ে স্বর্গ রচনা করেছে। আনন্দে আমাদের তিন বন্ধুর মন ভরে উঠল। জোয়ারের জল বাড়ছে। বেলাভূমির বিস্তৃতি কমছে। আমরা তিনজনে সাগরের সুনীল জলে নেমে গেলাম।