যাওয়া-আসার পথের ধারে (পর্ব-৪) ॥ প্রবীর বিকাশ সরকার


ইতিহাসের ছাত্র হিসেবেন এবং ষাটোর্ধ জীবনের অভিজ্ঞতায় বাঙালি চরিত্র যতখানি বুঝতে পেরেছি তার মধ্যে গভীর ভাবে লক্ষ্য করে দেখেছি, আমাদের চারিত্রিক গুণাগুণের চেয়ে দোষত্রুটি আর অবজ্ঞার ঝুলি অনেক বেশি ভারি। এতই ভারি যে অবহ। অচলায়তন। তাই আমরা সহজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি না। ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা যতই বেশি এবং শক্তিশালী হোক না কেন তার সঙ্গে জাতিগত দোষত্রুটির সম্পর্ক নেই।

সেইসব জাতিরাই মহান যারা মানবকল্যাণ এবং প্রকৃতি রক্ষার্থে সবচেয়ে বেশি সচেষ্ট এবং অগ্রগামী। সেই সব জাতি কখনোই সরকার বা শাসকের ওপর নির্ভর করে না। বাঙালির জাতিগত চিন্তাই হচ্ছে: সরকার সব করে দেবে বা দিতে হবে। বাঙালির পরিবারে সন্তানরা বিশ্বাস করে যে, পিতাই সব করে দেবে। পিতাকেই সব করতে হবে। আমার বাবা এই বদ্ধমূল ধারণা বা বিশ্বাসের ঘোর বিরোধী ছিল। বাবা বলেছিল আমাকে, “ভরণপোষণ ও শিক্ষাগ্রহণ পর্যন্ত আমার দায় দায়িত্ব। শিক্ষা শেষ করার পর নিজের পায়ে দাঁড়ানো ও সহায় সম্পত্তি অর্জন নিজেদের মতো করে নেবে, আমি করে দিতে পারব না, সে দায়িত্ব আমার নয়।”

ভীষণ থমকে গিয়েছিলাম বাবার মুখে এই কঠিন কথা শুনে! আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। চোখেমুখে অন্ধকার দেখলাম! বুঝেনিলাম যে, আমি পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। আমাকে রোজগারের চিন্তা করতে হবে, বাবাকে সহযোগিতা করতে হবে সংসার চালাতে, ছোট ভাইবোনগুলোকেও যথাসাধ্য সাহায্য করতে হবে শিক্ষা সমাপ্ত করা পর্যন্ত।

পরিবার তো একজনের একার নয়-যত জন সদস্য ততজনের যৌথ খামার। সবাইকে পরস্পরের ওপর নির্ভর করতে হবে। এর বিকল্প মানে ভাঙন ও দুর্বল হয়ে যাওয়া। বাবাও করবে, ছেলে মেয়েরাও করবে। এই জন্য জার্মানিরা উদ্ভাবন করেছিল “আরবেইট” বা “স্টুডেন্টজব”-বয়স ১৪-১৫ হলেই পড়ালেখার পাশাপাশি পার্ট টাইম জব করতে হবে, নিজেদের পকেট মানি নিজেকে আয় করতে হবে। এবং রাষ্ট্র ও সমাজ সেই সুযোগ করে দিতে বাধ্য।

জাপানে এসেও আমি ছাত্রাবস্থায় তাই করেছি। পার্ট টাইম জব থেকে আয়কৃত টাকার সামান্য হলেও বাবা-মাকে পাঠিয়েছি। ভাইবোনদের হাত খরচ দিয়েছি। সুতরাং এটাই হচ্ছে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন। যাকে ধরে রাখা ও ক্রমাগত সুদৃঢ় করাই মানুষের নৈতিকতা। কাজেই সরকার ও জনগণের মধ্যে একটা অদৃশ্য বন্ধন রয়েছে বইকি। রাষ্ট্র এই দুটো মানদণ্ডের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং পরস্পর নির্ভরশীল। সরকার জনগণকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে, জনগণও সরকারকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে এটাই হচ্ছে আসল গণতন্ত্র।

পরস্পরকে বুঝতে পারাটাই গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত। যেটা আমরা উন্নত দেশগুলোতে লক্ষ্য করে থাকি।
তারপরও, মানবসমাজ বলে কথা। মতপার্থক্য, আদর্শগত ভিন্নতা এবং হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে কিছুনা কিছু মানুষের মধ্যে। তবে তা যেন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করতে না পারে সচেতন মানুষকে সজাগ থাকতে হয়, সরকারকেও নিয়মিত নজরদারি করতে হয়। আর এভাবেই সামষ্টিক সমৃদ্ধি ও শান্তি বজায় থাকে প্রতিষ্ঠানে, সমাজে ও রাষ্ট্রে।

কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, স্বাধীনতার ৫০ বছরের মুখোমুখি হয়ে বাংলাদেশ কোন পথে আছে তা আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। একটি প্রবচন আছে, একমাত্র পরমেশ্বর ছাড়া জগতের সবকিছু পরিবর্তনশীল। পরিবর্তন ও বিবর্তনই জাগতিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির চালিকাশক্তি।
আমিও জাপানের মতো সভ্য-সুন্দর একটি দেশে না এলে এবং নিজেকে পরিবর্তনের লক্ষ্যে শিক্ষা না নিলে আমিও অধিকাংশ বাঙালির মতো গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে জীবন পার করে দিতাম, তাতে কোনো প্রকার সন্দেহ নেই। জাপান থেকে আমি যা শিখেছি, তাতে দেখতে পেলাম, জাপানিরা সবসময়ই ভিন্ন চিন্তা করেন। তাই তারা সদা অগ্রসরমান এবং বৈচিত্র্যময়। আমার বাবা একবার আমাকে বলেছিল, “মহাত্মা গান্ধির একটি বিখ্যাত উক্তি আছে জানো কি? সেটা হলো: থিঙ্ক ডিফরেন্ট। ভিন্ন চিন্তা করো।”

এই একটি বাণীই আমার মনে চিরকালের জন্য গেঁথে গিয়েছিল। আর জাপানে এসে পরিবেশগত কারণে এই বাণীটির বিকল্প নেই বুঝতে পেরে নব্বই এর প্রথমার্ধে ভিন্নমাত্রা ও স্বাদের একটি মাসিক কাগজ প্রকাশ করেছিলাম। যার নাম “মানচিত্র”, এটা ছিল আমার জীবনের একটি স্বপ্ন সমান বড় প্রকল্প। একই সময় কুমিল্লায় “মানচিত্র বইঘর” নামে একটি আধুনিক বইয়ের দোকানও দিয়েছিলাম। অনেকেই বলেছেন, এরকম ভিন্ন মাত্রার বইয়ের দোকান সারা বাংলাদেশেই খুব বেশি একটা ছিল না। ব্যবসা আমার শতভাগ লক্ষ্য ছিল না, দেশ ও জাতি গঠনে নতুন প্রজন্ম তৈরি করার উদ্দেশ্যও ছিল। সেই সুযোগটা কতিপয় তরুণকে দিয়েছিলাম, কিন্তু তাদের মধ্যে ভবিষ্যৎপাঠ করার ক্ষমতা ছিল না। ব্যক্তিক সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে সামষ্টিক হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে টিকলনা মানচিত্র প্রকল্পটি।

আবার ভিন্ন চিন্তা করলাম একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে আর তা হলো: শিশুদের জন্য একটি কাগজ। একটি দৈনিক শিশু সংবাদপত্র, জাপানে যেমন আছে দুটি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য। কিন্তু আমার সঙ্গে চিন্তার ভিন্নতা হচ্ছে, জাপানের দুটি দৈনিকে শিশুদের অংশগ্রহণ ন্যুনতম, অধিকাংশ লেখা ও সংবাদ বড়দের লিখিত। আমি চাই, শিশু সংবাদপত্র বা শিশু ম্যাগাজিন হতে হবে শতভাগ শিশু-কিশোর-কিশোরীদের নিজস্ব চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের কাগজ, যাদের বয়স শূন্য থেকে ১৮ পর্যন্ত।

তারা মাতৃভাষা চর্চা করবে এবং নিজেদের মতো করে লিখবে। বড়দের লেখা থাকবে মাত্র ১ শতাংশ। আপাতত দৈনিক না হোক, মাসিক হিসেবে দু দফায় “কিশোরচিত্র” নামে অনেকগুলো সংখ্যা প্রকাশ করেছিলাম আমার চিন্তানুয়ায়ী-শতভাগ লেখাই ছিল শিশু-কিশোর-কিশোরীদের। পত্রিকাটি দেখে জাপানি বিদগ্ধ জনরাই বলেছিলেন, কোদোমো শিম্বুন তোশিতে কোরেওয়া হোনতোওনি মেজোরাশিই! অর্থাৎ, শিশুপত্রিকা হিসেবে এটা সত্যিই ব্যতিক্রম!

২০১১ থেকে ২০১৩ সালের শেষভাগ পর্যন্ত “কিশোরচিত্র” প্রকাশিত হয়েছে কুমিল্লা থেকেই। একইসঙ্গে পুনরায় “মানচিত্র বইঘর” চালু করেছিলাম নূরপুর হাউজিং এ আমার বাড়ির ছাদে দুটি কক্ষ নির্মাণ করে। একটিতে মানচিত্র বইঘর অন্যটিতে কিশোরচিত্রর দপ্তর করার পরিকল্পনা ছিল, অনেক দূর এগিয়ে গিয়েও করতেপারিনি। ভেবেছিলাম কুমিল্লার পূর্বাঞ্চলটি সবচেয়ে অবহেলিত, মানচিত্র ও কিশোর চিত্রর মাধ্যমে শিশু-কিশোর-কিশোরী তো বটেই, তরুণ ও প্রবীণদের জন্যও একটি মুক্তচিন্তা ও অবাধ মেলবন্ধনের নন্দনকানন প্রতিষ্ঠা করব। এবং এটা সম্ভবও। সরকার বা নগর দপ্তরের সাহায্য-সহযোগিতার কোনো প্রয়োজন নেই। ব্যক্তিক উদ্যোগেই পৃথিবীতে বড় বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যারা ছোট থেকে বড় হয়েছেন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দিকে ভুলেও তাকান নি। আমারও তাই চিন্তা ছিল প্রথম থেকেই। যদি কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে সেটা ভিন্ন কথা।

আরও একটি গোপন ইচ্ছে ছিল আমার যে, দীর্ঘ কালব্যাপী কুমিল্লার কবি, লেখক, সাংবাদিক ও শিল্পীদের মধ্যে সমন্বয় নেই, ঈর্ষা, পরশ্রী কাতরতা বিদ্যমান জোরালো ভাবেই। এটা শহরবাসী সবাই জানেও। এটা মেনে নিতে পারিনি। সৃজনশীল প্রতিযোগিতা থাকবে, হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে কেন? কেউ কারো ছায়া দেখতে নারাজ এই ছিল অবস্থা। ফলে ভালো কিছু করা, উজ্জ্বল কিছু করার প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। “পথিকৃৎ কুমিল্লা”কতখানি পিছিয়ে গেছে অন্যান্য জেলাগুলোর চেয়ে বিগত ২৫-৩০ বছরে তা সহজেই বোঝা যায়। ২০০৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত কুমিল্লার সৃজনশীল ক্ষেত্রে অদৃশ্য বন্ধ্যাত্বটা আমি টের পেয়ে ব্যথিতই হয়েছি শুধু। তাই চেষ্টা করেছিলাম সৃজনশীল এবং নেতৃত্বশীল নবীন-প্রবীণদের পারস্পরিক ভাববিনিময় এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনে একীভূত করার জন্য।

সেই চিন্তা থেকে মানচিত্র বইঘর পুনরায় চালু করেছিলাম এবং ছাদের খোলা প্রাঙ্গণে জনা শতেকের সমাবেশ করার ব্যবস্থাও করেছিলাম। কয়েকটি অনুষ্ঠানও হয়েছিল। শহরের খ্যাতিমান নবীন-প্রবীণ প্রায় সবাই আমার আহবানে সাড়া দিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। কে বলে বাঙালি পারে না! অবশ্যই পারে, দরকার শুধু ব্যক্তিক সঙ্কীর্ণতা থেকে বেরিয়ে সামষ্টিকে উন্নীত করা প্রত্যেকের নিজকে। এই এক জায়গায় অনড় দাঁড়িয়ে আছে বাঙালি, তাকে সরে আসতে হবে, নাড়াতে হবে।
টোকিও ১.৪.২০২১