বইমেলার স্মৃতি ॥ মিতালী হোসেন


গ্রাফিক্স: লংরিড

আমরা যখন ছোট বেলায় মফস্বল শহরে থাকতাম, তখন প্রতি ডিসেম্বরে সেসব ছোট শহরগুলোর কোনো স্কুল বা কলেজের বিশাল মাঠে “এক্সিবিশন” হতো। এক্সিবিশন মানে আসলে এক রকম মেলা। দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে অনেক চমৎকার জিনিস, যেমন-চুড়ি, মালা, কাপড়, শীতবস্ত্র, রান্নার হাড়ি, কড়াই, খুন্তি, বটি, দা, শীল-পাটা ইত্যাদি এনে বিক্রি হতো। কোনো স্টল নয়, মাটিতে মাদুর বিছিয়ে এই শিল্পীরা তাদের পণ্য প্রদর্শন করতেন এবং খুব কম দামে বিক্রি হতো দর্শনার্থীদের কাছে। এছাড়াও থাকতো না না রকমের মুখরোচক খাবার-চটপটি, হালিম, ফুচকা, চিনির পুতুল, কদমা, কটকটি, বাদাম পাপড়ি।এ তো গেলো মেলার অংশ।

এছাড়াও যেটা থাকতো তা হলো অদ্ভুত প্রাণী, মানুষ ও তাদের না না রকম কর্মকাণ্ডের প্রদর্শনী।বুঝতে পারলেন না তো? বলি, আমিই যেমন এমন এক এক্সিবিশন এ দেখেছিলাম তিন শিংওয়ালা গরু। একটা ছাগল দেখেছিলাম যে সারাদিন বিড়ি টানে।একটা মহিষ এনেছিলো কোনো এক এক্সিবিশন এ যার পেটের কাছে অবিকল মানুষের হাতের মতো হাত আছে।এছাড়াও থাকতো অনেক খাটো মানুষ, অনেক লম্বা মানুষের খেলা, সার্কাস, মোটর বাইকের খেলা, মোরগ লড়াই, কুস্তি।এই এক্সিবিশন এর মূল আকর্ষণ থাকতো যাত্রা। যে কদিন এক্সিবিশন চলতো, প্রতি রাতেই যাত্রা হতো।সেটা কোনো অশালীন কিছু নয়।নবাব সিরাজদ্দৌলা, মহুয়া, নকশীকাঁথার মাঠ এর মতো চমৎকার সব নাটক বা যাত্রা প্রদর্শিত হতো।

যা হোক এসব উদ্যোগ আমাদের বাংলার সংস্কৃতির একটা অপূর্ব অংশ ছিলো। ছিলো বলছি কেন না, হারিয়ে গিয়েছে এমন আয়োজন।
আমাদের জীবনে এই সব আয়োজনগুলোর ভীষণ ইতিবাচক প্রভাব ছিলো। সারা বছর সবাই এই রকম আয়োজনের অপেক্ষা করতেন। আমার মাকেই বহুবার বলতে শুনেছি শীতে মেলা থেকে লোহার কড়াই কিনবো বা নতুন ভালো মানের শীল-পাটা আনবো।

কালে কালে, আধুনিক হতে হতে হারিয়ে যাওয়া এসব মেলা বা প্রদর্শনীর জায়গায় অনেক ভালো উদ্যোগ স্থান করে নিয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম।এসেছে বাণিজ্য মেলা, বইমেলা (বিশাল করে), পৌষ মেলা, পিঠা উৎসব, বর্ষা বরণ ইত্যাদি।শুধু ঢাকায় না, ঢাকার বাইরেও এই রকম উৎসবের আয়োজন হয় এখন।বিশেষ করে বইমেলা। তখনো বইমেলা হতো। অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে আমরাও ঢাকায় আসতাম। এই যে “অমর একুশে বইমেলা”-কথাটা উচ্চারণ করতাম পরম শ্রদ্ধার সাথে।কত শত হাজার বই, না না রঙের, ছবির বই। সে সাথে দেশি বিদেশি কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের আনাগোনা, আড্ডা, সেমিনার! সব মিলে একটা অসাধারণ পরিবেশ!

কিন্তু এখন?
এবার?
এবারের বইমেলাকে আমার কাছে গ্রামের এক্সিবিশন এর মতো মনে হচ্ছে কিন্তু সেই এক্সিবিশন ছিলো ভীষণভাবে ইতিবাচক আর এই এক্সিবিশন ভয়ংকর ভাবে নেতিবাচক।তখন যেমন বিড়িখোর ছাগল দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়তো লোকেরা এখন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ঐ বিড়িখোর ছাগল বা তিন শিং ওয়ালা গরুর থেকেও অদ্ভুত কিছু জীব দেখতে।বাক স্বাধীনতা বা লেখার স্বাধীনতা আছে-এই কথা বলে কুরুচিপূর্ণ বই প্রকাশ করে নষ্ট করেছ মেলার পরিবেশ এই জীবগুলা।ঐ বিড়িপ্রেমী ছাগল কিন্তু মেলার পরিবেশ দূষণ করেনি, এরা এবং এদের কুৎসিত বিষয়বস্তু সম্পন্ন বই নষ্ট করছে বইমেলার পরিবেশ।

প্রতি বছর সন্তানদের নিয়ে একদিন অন্তত মেলায় যেতাম।বই কিনতাম, বাচ্চাদের বই কিনে দিতাম।কত প্রিয় মুখের দেখা মিলতো মেলায়।বড় বড় মানুষের সান্নিধ্য আমার সন্তানকেও অনুপ্রাণিত করবে বড় হতে, এই বিশ্বাস থেকেই এই সুন্দর পরিবেশের অংশ হতে যেতাম।কিন্তু এবার বইমেলায় যেতে ভয় হচ্ছে। ছেলে বড় হচ্ছে। ডিজিটাল যুগে তার কাছে কোনো কিছুই গোপন নয় আর এখন। মেয়েও অনেক কিছুই বোঝে। শিশুমনে এসব কি প্রভাব পড়বে কে জানে! অনেকেই বলবে যে ঐদিকে না গেলেই হয়! না দেখলেই হয়!

কিন্তু মনে রাখা উচিত বাতাস যখন দূষিত হয়ে যায় তখন যেদিকেই ছুটি না কেন, দূষণ কিন্তু পিছ ছাড়ে না!

@ লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া, কিছুটা সংক্ষেপিত