আমার স্মৃতিতে হেলাল হাফিজ ॥ শামীম আজাদ


সাহিত্য আড্ডায় সমসাময়িক কবিদের সাথে হেলাল হাফিজ। ছবি: শামীম আজাদ

যখন হেলালের একুশ বয়স ছিল। আর আমি হয়তো অষ্টাদশী ছিলাম। তখন আমাদের দেখা হয়নি। দেখা হয় আমার যখন একুশ বছর। আর আমি রোকেয়া হল থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে কলাভবনে যাচ্ছি। ডান দিকের মাঠে নভেরার ভাস্কর্য ফেলে এগুতেই আমার পাশ থেকে ফিসফিস করে শ্রাবণী বলে উঠেছিল, এই রে আবার সেই সব কবি!

দেখলাম শরীফের ক্যান্টিন থেকে ক’জনের সঙ্গে বেরিয়ে আসছে চোখে না পড়ার মতো রোগা হেলাল হাফিজ। বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগারের সামনে এসে বারান্দায় বসা নির্মলেন্দু গুণকে দেখে দাঁড়িয়েছে। তারপর সবাই মিলে কি নিয়ে যেন হো হো করতে লাগলো। আমাদের মনে হলো বিষয় বুঝি আমরাই! আমি আর শ্রাবণী দ্রুত পা চালিয়ে ওদের পেরিয়ে গেলাম।

সে সময় আমি নিয়মিত ছোটগল্প লিখছি। মাথা পুরোটাই গল্পে ডোবা। কিন্তু কবি হবার দারুণ সাধ! তাই ওদের নিয়ে আমার প্রবল আগ্রহ। আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, সাজ্জাদ কাদির ও রফিক কায়সারসহ সবার প্রতি। বন্ধুত্ব করারও খুব ইচ্ছা। সতীর্থ বন্ধু ও কবি রফিক নওশাদ ও শাহনূর খান আবার ওদেরই আঠা। ক্লাস শেষে শীতের রোদে হেলান দিয়ে এদের কাছ থেকেই কবিগণের কি সব অদ্ভুত কাণ্ডগুলোর গল্প শুনি। জানি তারাও আমাদের চেনেন। শুধু পরিচয়টা বাকি।

অতঃপর কীভাবে হেলালের সঙ্গে পরিচয় হলো গল্প কিন্তু সেটা না। গল্প আমাদের বন্ধুত্ব আর আড্ডা নিয়ে। আর ততদিনে তার সুকুমার চেহারার বড় বড় ভাসা ভাসা চোখজোড়া বাদ দিয়ে সবার চোখে পড়তো তার মাথায় মাঝখানে সিঁথি করা তেল দেয়া বাবরি চুল আর মধু কবির মতো দাড়ি। এর কোনোটারই প্রাচুর্য ছিল না তবু নজর চলে যেত সেদিকেই। দেখলেই বুঝতাম দাড়ি ও চুলের চাষাবাদে নিজেকে সে ব্যস্ত রাখে বেশ কিছুক্ষণ।

যে প্রেসক্লাব তার বাড়িঘর সেখানেই, অথবা দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীবের কক্ষে কিংবা সাপ্তাহিক বিচিত্রায় আমার টেবিলেই জমেছে আড্ডা। বাংলা একাডেমির বইমেলা যখন বাংলা একাডেমি চত্বরেই হতো। যখন মানুষ মাত্র হাজার খানেক হতো আর জল ছিটিয়ে ধুলো ওড়া বন্ধ করতে হতো না। যখন লাল বর্ধমান হাউসের অর্ধ ওভ্যাল সিঁড়িগুলো ছাড়িয়ে, জলহীন পুকুর পেরিয়ে এদিকটায় ঘাসভরা মাঠ ছিল- আমরা সেখানে বসতাম। দেখতাম পাশ দিয়ে একদল তরুণের সঙ্গে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছেন হুমায়ুন আজাদ, অনতি দূরে এক গাদা লিটল ম্যাগ হাতে খন্দকার আশরাফ, ক্যামেরা নিয়ে ঝাকড়া চুলের শামসুল ইসলাম আলমাজী। মাঠে বসে বসে টুকটাক খুনসুঁটি করছি, আমরা কেনা বইয়ের গন্ধ শুঁকছি আর চেষ্টা করছি মাইকে কার বইয়ের কথা বলছে তা শুনতে। গল্প করতে করতে বুঝতাম ফেব্রুয়ারির শীত ও আড্ডা জড়িয়ে ধরেছে আমাদের। শাড়ি টেনে পিঠটা ঢেকে নিতাম।

কিছু কিছু পুরুষ আছেন না নারীবান্ধব, হেলালের টাইপটা ছিল সে রকম। এই টাইপটা পুরুষের এক বিশেষ গুণ বিধায় আমি একটু খুলেই বলি। এদের সঙ্গে বসে এক ঘণ্টা গল্প করলেও আপনি যে নারী এবং তাদের থেকে আলাদা সেটার চল্টা উঠে আসবে না। আপনি যে স্তন, নিতম্ব সর্বস্ব নন সেটাও বুঝতে পারবেন। জানবেন ওরা ঠিকই চটপটির প্লেটে আপনার জন্য টক বেশি চাইবে। হাঁটার সময় সঙ্গে রাখার জন্য ঘোষণা ছাড়াই হাঁটার গতি কমিয়ে দেবে। হেলালকে আমি কখনো জোরে ছুটে যেতে দেখিনি। অট্টহাস্য করতেও। এমনকি টেবিল চাপড়াতেও। সে কথা বলে নরম নরম। তাই শুনে অন্যরা করে টেবিল গরম। সে বিচিত্রায় এলে তার কথা শুনে দীর্ঘদেহী কবি মাহমুদ শফিক টেবিলে কয়েক বার কিল না মেরে বাঁচেই না।

হেলাল ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতা লিখে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও তখনও কোনো কবিতার বই প্রকাশিত হয়নি। এখনও হেলালের গ্রন্থসংখ্যা খ্যাতির কথা বিবেচনা করলে কিন্তু প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা কমই মনে হয়। সেবার বাংলা একাডেমি মেলায় হেলালের প্রথম কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ এসে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। বইটি বের করেছেন অনিন্দ্য প্রকাশনীর নাজমুল হক। আলেকজেন্ডার প্রেস থেকে লাইনো প্রিন্টে ছাপা হয়েছে। সেই আশির দশকে ঢাকা শহরে দু’জায়গায় লাইনো মেশিন ছিল। এক আমাদের দৈনিক বাংলা ও বিচিত্রার। দুই আলেকজেন্ডার প্রেস। বইটি মেলায় হাতে হাতে ঘুরছে। তাকে নিয়ে চলছে আলোচনা ও কথাবার্তা। সেবার আমার ও তসলিমার বোধ করি প্রথম এবং দ্বিতীয় বই এসেছে। কিন্তু কোনো আওয়াজ তুলছে না। আমরা দু’জন নিজেদের ক’টি চেনা স্টলে ক’খানা করে বই দিয়ে আসি এবং মাঝে মাঝে তার খোঁজ নিই আর নিয়মিত আড্ডা দিই হেলালের সঙ্গে। হেলালকে দেখলেই হাসতে হাসতে বলি, কষ্ট নেবে কষ্ট। গরম গরম কষ্ট। চরম গরম কষ্ট! আমাদের বাঁধা টেবিলে কখনো আসেন রফিক আজাদ, সাইয়ীদ আতিকুল্লাহ, হাবিবুল্লাহ সিরাজী, তারিক সুজাত, মাকিদ হায়দারসহ অগ্রজ-অনুজ সম কবি ও সাহিত্যিকগণ। হেলালের বই-ই বিষয়। তার বই কিনে ত্রুন-ত্রুনীরা এখান থেকেই নিয়ে যায় অটোগ্রাফ। হেলাল আমাদের দিকে প্রীত ও হাস্য মুখে লেখে, নিউট্রোন বোমা বোঝ মানুষ বোঝ না!

প্রেসক্লাবে কখনো এক টেবিলে পেলে সে গল্প হতো অন্য রকম। জন্ম শহর নেত্রকোনায় বাবা কবি ও শিক্ষক খোরশেদ আলী তালুকদার শিশুপুত্রকে নিয়েই সব জায়গায় যেতেন। এমনকি তার ও খালেক দাদ চৌধুরীর প্রকাশিত সাহিত্য সাময়িকী ‘উত্তরাকাশ’র অফিস, সিদ্দিক প্রেস বা সাহিত্য আড্ডায়। হেলাল খুব সুন্দর টেনেটেনে সুস্পষ্ট স্বরে কবিতা আবৃত্তি করতেন। বাবার ছিল এক ভারী মজার বিষয়। সে হলো ঋতুর রং মিলিয়ে পাগড়ী পরা। সাদা, গোলাপি, কমলা।

সবাই তাকে সে নামেই ডাকতো। ছোট বেলা মা হারানোয় পাড়ার খালা, মাসি, দিদি, চাচীদের পেয়েছে অনেক আদর। ‘আমি আসলে ওদের কোলে কোলেই বড় হয়েছি শামীম, আর বন্ধুদের সাহচর্যে। এই কোভিডকালে তার প্রেসক্লাব বন্ধ। যে হোটেলে থাকতেন বন্ধ সেটাও। এখন হেলাল বড় ভাইর বাসায় আছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপর সামরিক পট পরিবর্তনের প্রতিবাদী সময়ে যে ত্রুন কবিগণ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন আমার বন্ধু হেলাল হাফিজ তার অন্যতম।

আপাত আবছা স্বরে কথা বললেও তার কবিতায় কঠোর গালি দেখে বিস্মিত হয়েছি। সে নিজেও সরকার, সরকারপ্রধান এদের গালি দিয়ে তোপের মুখে পড়ে পালিয়ে বেরিয়েছে। এদিকে একই সময়ে ছেলেমেয়েরা প্রেমে, অবসাদে, আনন্দে, বিদ্রোহে হেলাল হাফিজের কবিতা ফেরি করে ফিরছে। বিশ্ব মানবতা ধ্বংসের মুখোমুখি বলে তার কবিতা গর্জে উঠেছে। হেলাল হাফিজের কবিতায় যেমন তার আত্মাটা কেমন করে কাঁপে তা বোঝা যায় তেমন তার বন্ধুত্বেও।