নিউইয়র্কের সাবওয়েতে সেদিন হঠাৎ একটি বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গেলো। যারা বই পড়েন না বা পড়ার সময় পান না তাদের বইয়ের মোহনীয় জগতে ফিরিয়ে আনাই ছিল বিজ্ঞাপনটির মূল উদ্দেশ্য।
বিজ্ঞাপনটির শিরোনাম ছিল 14 Ways to Cultivate a lifetime Reading Habit । ভাবলাম, কি সেই চৌদ্দটি টোটকা বা গোপন অলিগলি পথ যা মারালে একজন বই বিমুখ মানুষকেও বইপ্রেমিক করে তুলে দিতে পারে। আমার বন্ধুদের জন্যে সেগুলো তুলে ধরছি।
১) সময় তৈরি করুন। প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচ থেকে দশ মিনিট পড়ার জন্যে সময় তৈরি করতে হবে। মানসিকভাবে আপনাকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যে শত ব্যস্ততার মাঝেও আপনি এই পাঁচ-দশ মিনিট প্রতিদিন বইয়ের জন্যে ব্যয় করবেন। যারা মনে করেন বই পড়ার সময় হাতে নেই তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো সময় হলো সকালের নাস্তা অথবা দুপুরের খাবারের সময়। এই সময়টায় আপনি বই পড়ে বুঝেন আর নাই বুঝেন শুধুমাত্র পাঁচ থেকে দশ মিনিট যদি নিয়ম করে বইয়ের উপর চোখ বুলিয়ে যেতে পারেন তাহলেই কিন্তু আপনি প্রথম ধাক্কায় উৎরে গেলেন।
২) যেখানেই যাবেন সঙ্গে একটি বই রাখার অভ্যাস করুন। আপনি যেভাবে আপনার ঘরের চাবি, ড্রাইভার লাইসেন্স সঙ্গে রাখেন ঠিক সেভাবেই ঘর থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি আপনার প্রিয় বইটি ব্যাগে তুলে নিন।
৩) আপনি যে ধরনের বই পছন্দ করেন তার একটা তালিকা তৈরি করুন। এই তালিকাটি আপনি আপনার ব্যক্তিগত নোটবুক, ডায়েরি অথবা জার্নালে টুকে রাখতে ভুলবেন না। যখনই আপনি আপনার প্রিয় কোনো বইয়ের নাম শুনবেন সঙ্গে সঙ্গে দেরি না করে বইটির শিরোনাম টুকে রাখুন এবং আপনার প্রিয় বইয়ের তালিকায় জুড়ে দিন। যে বইগুলো আপনার পড়া হয়ে যাবে সেখানে একটা ক্রস চিহ্ন দিয়ে আপনি আপনার তালিকাকে প্রতিদিনই আপডেট করতে পারেন।
৪) নিরিবিলি একটা জায়গা নির্বাচন করুন। প্রচুর বন্ধু-বান্ধব, হৈ হট্টগোলের মাঝে বই পড়া সম্ভব হয় না। সে কারণেই আপনি আপনার পছন্দমতো একটা নিরিবিলি জায়গা নির্বাচন করতে পারেন যেখানে আশে পাশে অন্তত কোনো টেলিভিশন, ইন্টারনেট বা এই ধরনের বিনোদনমূলক কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। নিজের জন্যে একটু শান্তিপূর্ণ সময় তৈরি করতে অসুবিধা কোথায়?
৫) টেলিভিশন/ইন্টারনেট/ফেসবুককে জয় করুন। মনে রাখবেন বই পড়ার সবচেয়ে বড় শত্রু হলো এই টেলিভিশন, ফেসবুক। আপনি অবশ্যই নিয়মিতভাবে টেলিভিশন দেখবেন, ফেসবুকে থাকবেন কিন্তু মনে রাখবেন কোনো নেশায় যেন আপনাকে কাবু করতে না পারে। জীবন মানুষের একটাই। আর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো একটা মেধাহীন টিভি সিরিয়াল বা ফেসবুকের উপর বসে থেকে সময় নষ্ট করার কি মানে?
৬) আপনার ছেলে-মেয়,বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বই নিয়ে আলোচনা করুন, তাদেরকে বই উপহার দিন আর বই বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের মজাদার তর্কে নিজেকে জড়িয়ে রাখুন। দেখবেন আপনি নিজেই এই তর্কে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন।
৭) বইয়ের একটা লগবুক তৈরি করুন। আপনি যে বইগুলো পড়ছেন তার আদ্যোপান্ত একটা ছোট ইতিহাস (কখন পড়তে শুরু করলেন, কবে শেষ হলো, বইটির উপর আপনার মন্তব্য, নোট ইত্যাদি) এই লগবুকে টুকে রাখুন।
৮) ছুটির দিনে বইয়ের দোকানগুলোতে ঢু দিন। ঠিকই শুনেছেন। ফাস্ট ফুডের দোকানে একটু কম গিয়ে বরং বইযের দোকানে সময় কাটান। দেখবেন সময়টা খারাপ কাটবে না। মনে রাখবেন শুধুমাত্র বই কেনার জন্যই আপনাকে বইয়ের দোকানে যেতে হবে তা কিন্তু নয়। বরং দেখবেন আপনার বইয়ের দোকানে আসা-যাওয়াকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের সঙ্গে আপনার একটি আত্মীক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আর হ্যাঁ, সন্তানদেরকেও সঙ্গে নিতে ভুলবেন না।
৯) স্থানীয় পাঠাগারের সদস্য হোন। যদি সদস্য হওয়া সম্ভব না হয় তাহলে অন্তত সপ্তাহে একদিন হলেও পাঠাগারে যান, সেখানে সময় দিন।
১০) আপনার পছন্দের বইটি পড়ুন। যে বই পড়লে আপনার ভালো লাগে শুধুমাত্র সেই বইগুলোই পড়তে চেষ্টা করুন। পণ্ডিত হওয়ার জন্যে বই পড়বেন না। আপনার যদি বিজ্ঞান পড়তে ভালো লাগে তাহলে সাহিত্যের পাতা না উল্টিয়ে আপনি বিজ্ঞান বিষয়ক পছন্দমতো বই পড়ুন। যে বই আপনার অন্তরাত্মাকে টানে সেই বিষয়কেই গুরুত্ব দিন। জোর করে কিছু হয় না।
১১) আনন্দের সঙ্গে পড়ুন। আপনার পড়ার সময়টাকে যত সম্ভব উপভোগ করার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে চা কফি সঙ্গে রেখে, প্রিয় চেয়ারে হেলান দিয়ে কম্বল জড়িয়ে অথবা যেভাবেই আপনি নিজেকে সহজ মনে করেন ঠিক সেই আনন্দের মানসিকতা নিয়ে বই পড়ার চেষ্টা করুন।
১২) আপনি নিজের জন্য একটা অনলাইল ব্লগ তৈরি করতে পারেন। এই ব্লগে আপনি আপনার পঠিত পুস্তক নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করতে পারেন। ব্লগে আপনি আপনার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজনদের সবাইকেই আমন্ত্রণ জানাতে ভুলবেন না।
১৩) বই পড়ার জন্য একটি ইস্পিত লক্ষ্য তৈরি করুন। ধরা যাক প্রতি বৎসর আপনি পঞ্চাশটি বই পড়বেন এমন একটি ইস্পিত লক্ষ্য তৈরি করুন। বৎসরান্তে আপনি আপনার সফলতা আর বিফলতার একটা খতিয়ান নিজেই তৈরি করে আপনি আপনার কাজের মূল্যায়ন করতে পারেন।
১৪) প্রতিদিন বই পড়ার চেষ্টা করুন। অতিরিক্ত কর্মব্যস্ততা, পারিবারিক দায়িত্ব, অতিথিয়েতা ইত্যাদি বিষয়গুলো আমাদের গার্হস্থ্য জীবনের অন্যতম এক বড় অংশ। এখান থেকে কিছুটা সময় নিজের জন্যে স্বার্তপরের মতো তৈরি করুন। মনে রাখবেন এই ব্যস্ততার মাঝেও আপনি যদি বইয়ের একটি পাতা নাও পড়তে পারেন তবু অন্ততঃ চোখ বুলিয়ে যান। তারপরও প্রতিদিন বই পড়ার জন্য সময় ব্যয় করুন।
তাহলে আর দেরি কেন? শুরু হোক আজ থেকেই। আর লেখাটি ভালো লাগলে বা আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে শেয়ার করতে পারেন। বইয়ের জন্যে একটি সামাজিক আন্দোলন এখন খুব জরুরি।