লেগুনা থেকে নেমে সোজা ড্রিম হোটেলে ঢুকে ক্যাশ কাউন্টারে দাঁড়ায় আব্বাস আলী আকন্দ। হিসাবটা মোটামুটি ঠিক করাই ছিল বাসা থেকে বেরুবার মুখে ফোন করে চম্পা পারুল স্কুলের হেড মাস্টার। দেখা করতে চান।
এখন এই অতিমারীর সময়ে স্কুল বন্ধ। অফিসে কিছুটা ছুটোছুটি করতে হয় বটে, তাকেও ছুটতে হবে সে কারণেই আসা তার সুস্পষ্ট ঈঙ্গিত দিয়েই রেখেছে আগে। তার মানে সে দেখা করতে এলে দরকারি কথার সূতোটা দীর্ঘ হয়ে অপ্রয়োজনের টানে ছুটবে। তখন কথা বলে যদি জেনে যেতে পারেন আজকের মূল আয়োজনটা কি? তাই আগেভাগেই তাকেও থাকতে বলতেই হবে।
এ তো আর ঘরের রান্না নয় যে তিনজনের রান্না চারজন খেতে পারবে। একজনের প্যাকেট একজনকেই দিতে হবে। গাড়ি নিয়েও আসতে পারে কেউ কেউ। ড্রাইভার থাকবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়ে আসবে গাড়ি। আগে নাক সিটকালেও এখন আর জেনে বুঝে নাকটা সিটকানোর আগে একবার হিসাব মেলাতে হবে।
আব্বাস আলী যাদের গাড়ি নিয়ে আসার চিন্তা করছে তারা কেউ নিজের টাকার গাড়ি নয় স্বামীর টাকার গাড়ি চড়ছে বহুকাল থেকেই। ভাবতে ভাবতে আরও ছয়টা প্যাকেটের হিসাব মিলিয়ে মোট সংখ্যার সাথে দাম যোগ করে এক হাজার টাকার দুটো নোট দিয়ে রিসিট নিয়ে নিয়ে। ডেলিভারি সময় বেলা একটা লেখা থাকে দুটো কাগজেই।
আজ হাঁটতে ইচ্ছে করছে না আব্বাস আলীর। হাত উঁচিয়ে রিকশা ডাকতে গিয়েও থেমে যায়। এইটুকুই তো পথ। এইটুকু পথ পেরুতে কখনও রিকশার প্রয়োজন হয়নি আব্বাস আলীর। গত দুমাস আগেও হয়নি। তাহলে আজ কেন? এটুকু ভাবতে ভাবতে রড় রাস্তা পেরিয়ে মসজিদের কাছে এসে পড়েছে। হঠাৎ মনে হলো ও কি রিসিটটা পকেটে তুলেছে না ক্যাশ কাউন্টারই রেখে এলো কি? পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে খুচরো কাগজপত্র বের করে আনে। অপ্রয়োজনীয় কিছু কাগজ আছে রিসিটটা নেই। বাম পাশের পকেট হাতড়ে মোবাইল বের আবার ঢুকিয়ে ফেলে।রিসিট নেই।
ঘুরে ফিরে যাবার জন্য কয়েক কদম যেতে যেতে পাঞ্জাবি পকেট খুঁজে মানিব্যাগ বের করে দেখে রিসিটটা ব্যাগের ভেতরে চুপটি করে শুয়ে আছে । আজকাল এমন ভুল হচ্ছে আব্বাস আলীর। এটা কি বয়সের দোষ। হতে পারে। অথচ একসময় নিজের মেধার ওপর বিশ্বাস ছিল। স্মরণ শক্তি, কথা মনে হতে নিজের দিকে তাকায়। না এখন বেশ শক্তপোক্ত শরীর তার।
স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকতেই শুয়ে থাকা একটা কুকুর উঠে দৌড়ে গেট দিয়ে বের হয়ে গেল। নিজের রুমে বসতে বসতেই মনোয়ার স্যার সালাম দিয়ে বসে পড়ে।স্কুলের খালা ট্রে নিয়ে হাজির। একটা পিরিজে সর মাখা একটা মিষ্টি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই
-স্যার কাল বাড়ির দোতলার ছাদ ঢালাই হয়েছে। তার মিষ্টি।
– খুব ভালো সংবাদ। খালা সবাইকে দিয়েছো।
– না স্যার আপনেরে পরথম দিলাম। ম্যাডামরা কইলো আগে স্যাররে দিয়া আসো হেরবাদে আমরা নেই।
খালা চলে গেল।
ঝকঝকে গ্লাসে টলটলে পানি দেখে মনে পড়লো তিনি খুবই তৃষার্ত।পানির গ্লাসটা তুলতে মনোয়ারের সাথে টুকটাক কথা হয়। অনুমতি নিয়ে সেও চলে যায়।আব্বাস আলী আকন্দ ধীরে সুস্থে পানি পান করে খুব তৃপ্ত হন।দরজায় কানিজ ম্যাডাম আর তার স্বামী। হাতে বিরাট ফুলের বোকে।ততক্ষণে চাউর হয়ে গেছে আব্বাস আলী জয়েন করার পর যতজন শিক্ষক অবসরে গেছেন আজ তারা আসছেন।
হৈ হৈ করে করে ঢুকেন মমতাজ ম্যাডাম
-স্যার একবারও তো বলেননি।
বরাবরের মতো হাসেন আব্বাস আলী।
– স্যার আমাদেরকেও বলতে মানা করছেন।
কানিজ ম্যাডাম মিটিমিটি হাসতে থাকেন।
একে একে সবাই আসেন। আসেন বললে ভুল হবে সবাই যেন এমন একটা ডাকের জন্য অপেক্ষা, কতদিন পর তাদের পুরানো কর্মক্ষেত্রে আসা। যেখানকার সম্পর্কের সূতো ছিঁড়ে গেছে নিয়মের চুক্তিতে। তবুও রয়ে গেছে তার অপ্রতিরোধ্য ছায়া। এটা সরাবার সাধ্য কার? কেউ কেউ সময় থাকতে বুঝতে চান না বিষয়টা, সময় গেলে হাতড়ে আফসোস করে। আব্বাস আলী বুঝতে পেরেছেন বলেই আজকে তিনি ডেকেছেন সম্পর্ক চুকিয়ে যাওয়াজনদের।
সবার কলকাকলীতে মুখরিত টিচার্স রুম। হাসি আনন্দ কথা ভেসে আসে। আব্বাস আলী কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। কত কাজ যে জমা আছে। গত পনরদিন ধরেই লাগাতার কাজ করে যাচ্ছে আব্বাস আলী।দরজায় দীর্ঘ ছায়া চোখ তুলতেই দৃষ্টি আঁটকে যায় ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতির দৃষ্টিতে।
দীর্ঘদিন আব্বাস আলী এই স্কুলে, রেখা খন্দকারও সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘদিন । তিনি নিজে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কমিটিতে থাকেন না বটে তার পছন্দের মানুষ থাকে। কখনো অযোগ্য মানুষও রাজনৈতিক বিবেচনায় দায়িত্বে আসেন। আব্বাস আলী সহ-সভাপতির নামটা সবসময়ই রেখা খন্দকারেক রাখেন। শিক্ষিত রুচিবান মানুষ। বিচারবোধ সম্পন্ন তার দূরদৃষ্টির প্রশংসা করতেই হয়। আব্বাস আলী আকন্দ আলী গত একুশ বছরে তিনজন সভাপতি পার করেছেন। একজন ছিল ধূর্ত। একজন তার সময়সীমা পার করার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর এখন যিনি আছেন তিনি জনপ্রতিনিধির কাছের লোক ছিলেন এখন বেশ দূরের। সহ-সভাপতি ঘরে ঢুকতেই আজানের ধ্বনি বাতাসে ভেসে ভেসে ঘরে ঢোকে।
কথা বলতে বলতেই মনোয়ার স্যার ঘরে ঢোকে। আব্বাস আলী মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে তার হাতে দেয় রিসিটসহ।
পাশের রুমে আনন্দ কলোরবে যোগ দিতে চলে যান রেখা খন্দকার।কাজের ফাঁকে ঢুকে পরেন চম্পা পারুল স্কুলের হেড মাস্টার পাশের স্কুলের হেড মাস্টার কানিজ ম্যাডামের স্বামী। সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদ আপগ্রেড করেছে। শিক্ষকদের কাগজপত্র জমা দিতে হবে অধিদপ্তরে। শিক্ষকদের মাথার ঘায়ে পাগল অবস্থা।
সুক্ষ্মভাবে শিক্ষকদের তিনটে দল আছে এখানে। আব্বাস আলী বুঝতে পারলেও মুখে কখনো কিছু বলতো না। এই যে তার বিদায় অনুষ্ঠান নিয়ে তিন দলের মধ্যে ঐক্য হয়নি সেটা তিনি জানেন। পুরানো শিক্ষকদের আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়ে তিন দলে যোগ বিয়োগের ফলশ্রুতিতে দুই দলে রুপান্তরিত হয়েছে। কোন দলের মতামতের তোয়াক্কা করেননি তিনি।
আজ এই সবাই এসেছে এটার পরিকল্পনা এবং বাদবাকি সব তার নিজের। কানিজ ম্যাডামের স্বামী বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন । হায় আল্লাহ আড়াইটা বেজে গেছে এখনও খাবার নিয়ে এলো না যে!
মনোয়ার স্যারকে ফোন দিতেই জেনে যায় আরো আধা ঘণ্টা লাগবে খাবার আনতে।
একটার খাবার আসবে তিনটায়।
ড্রিম হোটেলের ম্যানেজারও কি জেনে গেছে!
এক কাপ চায়ের কথা কি বলবে কানিজ ম্যাডামের স্বামীকে। তার নিজের ডায়বেটিস না থাকলেও জানে এইসব রােগীদের নিয়ম মেনে খেতে হয়। কানিজ ম্যাডামের স্বামীর কি ডায়বেটিস আছে?
উঠে টিচার্স রুমে যায়। কেউ কেউ কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ত। কেউ কেউ গল্প করছে।
-স্যার খাবার আসতে এত দেরি কেন হচ্ছে। গেস্ট এসে বসে আছে।
জাহানারা ম্যাডাম নড়েচড়ে বসেন।
– তাতে কি আমরা তো গল্প করছি সমস্যা হচ্ছে না।
-না আপা আপনি না বললে কি হবে। এত দেরি কেন খাবার আসতে বলুন তো স্যার। কখনো কি এমন হয়েছে।
রাবেয়া ম্যাডামের তীব্র কণ্ঠে একটা সুক্ষ্ম জ্বালা আছে টের পায় আব্বাস আলী আকন্দ।
দরজা থেকে একটু এগিয়ে যায় আব্বাস আলী
– আমি খাবারের অর্ডার আগেরদিনই দিয়ে গেছি। আসার সময় অগ্রিম টাকা দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে এলাম বেলা একটা। অথচ আড়াইটায়ও শুনি আরো আধ ঘণ্টা। বলেন তো কেমন লাগে।
-কখনো তো এমন হয়নি। আজ কেন হলো।
কথাগুলো শুনে মনে হলো সত্যিই তো কখনো তো এমন হয়নি তাহলে বেছে বেছে আজই হতে হলো।
ড্রিম হোটেলে ম্যানেজার কি জেনে গেছে আব্বাস আলী আকন্দ রিটায়ার্ড করেছে। এখন এই এলাকায় তার আর প্রভাব প্রতিপত্তি নেই। তাই তার কথা গুরুত্বসহ বিবেচনা না করলেও চলবে। একটার অর্ডার তিনটের পর দিলেও চলবে।
এমন মনে হলো কেন? রিটায়ার্ড নিয়ে তো কখন তার নিজের মনেও কোন ক্ষোভ যন্ত্রণা হতাশা নেই। বরঞ্চ একটা পরিতৃপ্তি নিয়ে তিনি আজ অবসর গ্রহণ করছেন। তার সবকাজ সম্পন্ন হয়েছে। ছেলে সরকারি চাকরি করে স্ত্রীর অবসর নিতে আরো বছরখানিক আছে। পুত্রবধূ চাকরি করছে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে জামাতা চাকরি করছে। মেয়ের মাস্টার্স বাকি আছে।
নিজের জমানো কিছু আর গ্রামের জমি কিছুটা ছাড়িয়ে পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট কিনে নিয়েছে। মাঝখানের দেয়াল সরিয়ে বেশ বড়সড় জায়গা জুড়ে বসবাস করছে পুত্র পুত্রবধূ নাতিসহ।
রিকশার শব্দে তাকাতেই মনোয়ার স্যারের সাথে চোখাচোখি হয়।
অসাধ্য সাধন করতে পেরেছি ভাষায় তার চোখ নেচে উঠে। পেছনের রিকশায় আনোয়ার স্যার।
খালা দৌড়ে যায় দু রিকশা ভর্তি খাবার আনেত। স্যাররা কেউ আনতে পারবে না। দ্রুত হাত চালিয়ে খাবার নিয়ে আসে।
হাতে হাতে টেবিলে প্লেট সাজিয়ে গ্লাস পানির বোতল খাবারের প্যাকেড দিয়ে দেয়। আব্বাস আলীর রুমে ছয়জন পুরুষ খেতে বসে।এতক্ষণের ক্ষুধার রোদে টলে যাওয়া মুখগুলো জল পেয়ে টলটল করে ওঠে।
খাবার পর্ব শেষ হতেই হেমন্তের বেলা দ্রুত ফুরিয়ে যাবার আয়োজনে ব্যাস্ত হয়ে পরে। শিক্ষকদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিতে হবে। পুরানো নতুন সবাই টেবিল ঘিরে বসে। দীর্ঘদিনের সহকর্মী। কত স্মৃতি সুমধুর কত কড়া শাসন কত চাপা মনোমালিন্য কিছু স্বচ্ছ বেদনা কিছু গভীর অদেখা কান্না আছে এদের। অভিযোগ থাকতেই পাররে আব্বাস আলীর বিরুদ্ধে। তিনি ব্যক্তিগত কারণে কখনো কাউকে সামান্য কথাটুকুও বলেনি। শুধুমাত্র প্রধান শিক্ষক হিসাবে কড়া ছিলেন। সহকারী শিক্ষকদের ক্লাস করা ছাড়া অন্যকোন কিছু সামলাতে হয়নি কখনো। ক্লাসের বিষয়ে কোন ছাড় দেননি কখনো। তবুও তো আব্বাস আলী, মানুষ। যদি কোন ভুল করে থাকেন। তারও কিছু কথা আছে।
আবেগঘন মুহূর্তের চোখ ভিজে ওঠে সবার। শক্ত শরীর শুকনো এঁটেল মাটির মনের আব্বাস আলীও কেঁদে ফেলেন। সবাই চলে গেলেও আব্বাস আলী বসে থাকে। হাতে কিছু কাজ আছে সেগুলো সারতে হবে।
খালাও চলে যায়। নতুন হেড মাস্টার এসে যেন কোন ওর কোন কাজে ভুল না পায়। আর এখন বদলি বন্ধ করোনা- কারণে। স্কুলের সবচেয়ে সিনিয়র টিচার কামরুন নাহার এর দায়িত্ব থাকলো প্রধান শিক্ষককের ভার বহন করার। তাকে সাহায্য করবেন দুজন পুরুষ শিক্ষক আনোয়ার স্যার ও মনোয়ার স্যার।সব কাজ গুছানোর পর পিরিজ দিয়ে ঢাকা গ্লাস ভর্তি পানি ঢকঢক করে পান করে একটা সুস্থির নিশ্বাস ফেলে।
নির্ভার লাগছে নিজেকে।
জানালা দিয়ে চোখ যায় মাঠে। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ তাই সারামাঠ সবুজ ঘাসে ভরে গেছে । ওঠে বারান্দায় দাঁড়ায়। বিরাট মাঠ পেরিয়ে কয়েকটি গাছ দাঁড়িয়ে আছে।এগুলো তারই উৎসাহে লাগানো হয়েছে। এখনও সাবালকত্ব পায়নি। দরজায় তালা লাগিয়ে বারান্দা পেরিয়ে গেটে তালা লাগিয়ে বের হয়ে পড়ে। চাবিটা দেবার প্রয়োজন নেই। টিপতালা তাই চাবিটা নিয়ে গেছে স্কুলের খালা।আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকে আব্বাস আলী।
কতদিন! চাকরির প্রায় অর্থেকের বেশি সময় এখানে কাটিয়ে দিল। মধ্য যৌবন থেকে পৌঢ়ত্ব। আনমনে মূল গেটের দিকে হেঁটে আসছে আব্বাস আলী আকন্দ। হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। নিজেকে সামলাতে সামলাতে বসে পড়ে। একটা বড়গাছের শেকড় মাটির উপর দিয়ে ওঠে আবার মাটিতে লুকিয়ে নিয়েছে নিজেকে। শেকড়টায় হাত রাখে। বেশ মোটা শেকড়। শেকড়টার কত বছর বয়স হবে? বিশ তো হবেই ।
এখানে আসার দুবছর পর ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা মিলে বনায়নের কার্যক্রমের অংশ হিসাবে গাছগুলো লাগিয়েছিল। প্রথমদিকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে যত্ম করতো। পরে মাটির সাথে চারাগাছগুলোর জনম চুক্তি বসতি হয়ে গেলে যত্ন আর করার দরকার পড়েনি।
মেহগনির বেশ কয়েকটি গাছ উঠে গেছে অনেক উপরে। সজীব পাতাগুলো ঝিলমিল আনন্দে বাতাসের সাথে কথা বলছে।
আকাশ-ছোঁয়ার বাসনায় ওঠছে উপরে। উঠে ধুলি ঝেড়ে সেজা হয়ে দাঁড়ায় আব্বাস আলী। ঠিক মেহগনি গাছগুলোর মতো। শেকড় পোঁতা মাটিতে, আর নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে আলো হাওয়ায়। পাতাগুলো মনের আনন্দে মেলে ধরছে জাগতিক আবহে।
আব্বাস আলীরও শেকড় পোঁতা ছিল এই স্কুলের চৌহদ্দিতে। নিজেকে বৃক্ষের মত করে শেকড় দিয়ে আঁকড়ে রেখেছিল। আজ চলে যাচ্ছে এখানকার সমস্ত কাজকর্ম শেষ করে। নতুন কেউ আসবে দায়িত্ব পালন করতে। মনটা ভারী হয়ে ওঠে। এতদিন!! জীবনের অনেকটা সময়।
চোখ ভিজে ওঠে। বুকের ভেতর খামচে ধরে অদৃশ্য হাত। গলার কাঁছে আঁটকে থাকা কান্নাটা ভারী হয়ে ওঠে। কতটা সময় এখানে। আগামীকাল থেকেই আব্বাস আলী আকন্দ ‘ছিল’ হয়ে যাবে।
উপরে তাকায় গাছের উপরজুড়ে আছে তিন ধরনের পাতা।
পুরানো পাতায় হলদে ছোপধরা মাঝবয়েসী পূর্ণ সবুজ পাতা সাথে নবীন পাতা। নবীন পাতাগুলোয় পৃথিবী দেখার কি অপার আনন্দ। ঝিরিঝিরি বাতাসে ফরফর করে উড়ছে।
হলুদ ছোপধরা পাতার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই গাল বেয়ে জলের ক্ষীণধারা নেমে আসে। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে ফেলে।
গাছটা হাত দিয়ে ধরে থাকে কেউ না বললেও তোরা বলিসরে আমিও ছিলাম আমি দিয়ে গেলাম জীবন নিংড়ে জীবনীশক্তি। হলুদ পাতা তোরাও ছিলিরে। সূর্যের আলো থেকে শক্তি নিয়ে গাছের জীবনীশক্তি জুগিয়ে ঝরে যাবি এটাই তো নিয়মরে…
আবার চোখ ভিজে ওঠে।
শহরে এত এত কিন্ডারগার্টেন ইংলিশ মিডিয়ামের পাশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কে আর সম্মান করে। নিম্নবিত্ত পরিবারে সন্তানরা লেখাপড়া করে এই স্কুলে। পরিবারে তেমন কোনো যত্ম নেই লেখাপড়ার, তেমন একটা স্কুলকে শতভাগ পাশের স্কুল করাই না শুধু, সত্যিকারের মূল্যবোধ তৈরি করতে চেয়েছে শিশুদের ভেতরে। দেশপ্রেম ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি দায়বোধ তৈরি করে দিয়েছে নিজের উদ্যোগে। এগুলো চাকরির নিয়মে মধ্যে ছিল না নিজের ভেতরের তাড়না থেকেই করতো আব্বাস আলী আকন্দ। অন্য স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে তার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রার্থক্য এখানেই।
নিজের শৈশবটাকে দেখতে চাইতো ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের মধ্যে।
নিজে কতকিছু হতে চাইতো করতে চাইতো শুধুমাত্র সুযোগর অভাবে করতে না পারলেও শৈশবটা ছিল সজীব আর শহরের শিশুদের শৈশব তো কবেই খুন হয়ে গেছে। এই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকরা বুঝতে পারতো আব্বাস আলী আকন্দ অন্য ধাচের শিক্ষক। কিছুটা বাড়তি সন্মান হয়তো ছিল তার প্রতি। বাড়তি খাটনির জন্য বিরাগভাজন হতো সহকর্মীদের। গাছগুলোতে হাত বুলায় আনমনে। গাছগুলো মূল্যবান সম্পদ হয়ে গেছে স্কুলের জন্য, নিজের দিকে তাকায় আব্বাস আলী আকন্দ। নির্জীব মূল্যহীন মনে হচ্ছে।
-সার অহনও যান নাই বেইল তো পইড়া গেল
চমকে তাকায় স্কুলের খালার দিকে।
– যাই।
হাঁটতে শুরু করে আব্বাস আলী আকন্দ। বেলা পড়ে যাওয়া সময়ে কর্ম জীবনের শেষ হাঁটা….