কবি ও সাহিত্যিক হাবীবুল্লাহ সিরাজীর মহাপ্রয়াণের বেদনাদায়ক সংবাদটা আজ সকালে (২৫ মে) বুকের জমিনে ধারালো তীরের মতো ছুটে এসে বিঁধল। মনটা বিষণ্ণতায় মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য।
আমি তার সাহিত্যকর্মের একনিষ্ঠ অনুরাগী ছিলাম। ছাত্রজীবন থেকেই তার কবিতা পড়ে আসছি। গদ্যও পড়েছি। অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। ইতিহাস সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান নানা রচনায় বিধৃত আছে এবং বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে আমার মধ্যে। জেনেছি অনেক কিছু তার প্রবন্ধ থেকে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের জন্য সুযোগ্য ব্যক্তিই ছিলেন তিনি, তাতে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না।
কী করেছেন বা করতে পেরেছেন সেটা বিচার্য হলেও, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইচ্ছে বা ক্ষমতা থাকলেও স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যায় না আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং অনুদার রাজনীতির কারণে। তিনি হয়ত পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন বলে ধারণা করি।
তিনি ছিলেন বলেই, আমি আমার একজন পরম শ্রদ্ধেয় বন্ধুর অনুরোধে ‘বঙ্গবন্ধু এবং জাপান সম্পর্ক’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছিলাম। বইটি কবে প্রকাশিত হবে জানি না, যখন প্রকাশিত হবে তখন তিনি থাকবেন না, ভেবে খুব কষ্ট পাচ্ছি।
সিরাজী ভাইয়ের সঙ্গে জীবনে আমার একবারই দেখা হয়েছিল ঢাকায়, তাও অপ্রত্যাশিতভাবে। ২০০৮ সালের জুন মাসে আমার প্রবন্ধ সংকলন ‘জানা অজানা জাপান’ (প্রথম খণ্ড) এর প্রকাশনা অনুষ্ঠান ছিল জাদুঘরের বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন জাপানের রাষ্ট্রদূত ইনোউয়ে মাসাইউকি, বিচারপতি হাবিবুর রহমান, প্রফেসর আনিসুজ্জামান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, কবি নির্মলেন্দু গুণ, রাজনীতিবিদ দেওয়ান সুলতান আহমদ এবং কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের।
সেদিন ঘণ্টা দুয়েকের অনুষ্ঠানে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, কারা উপস্থিত ছিলেন দেখার সুযোগই হয়নি! হল ভরে গিয়েছিল এটাই দেখেছি একবার।
অনুুষ্ঠান শেষ হতেই জাদুঘরের মহাপরিচালক বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক সমর পালের আয়োজনে চা-অনুষ্ঠানে আরও ঘণ্টাখানেক সময় কাটাই মাননীয় অতিথিদের সঙ্গে।
এরপর যখন জাদুঘর থেকে বেরিয়ে আসি তখন প্রাঙ্গণে দেখা হয়ে যায় বেশ কয়েকজন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে। কে যে আমাকে সিরাজী ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আজ আর স্মরণে নেই। সেই প্রথম তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে পরিচিত হওয়া।
সেদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিয়েছিলাম আধ ঘণ্টা। নানা কথা বলছিলাম আমরা জাপান সম্পর্কে। সিরাজী ভাইয়ের আগ্রহ ছিল খুব জাপান বিষয়ে। নানা প্রসঙ্গে কথাও বললেন আমাকে। বেশ ধারণা রাখেন আমার মনে হল। আপাদমস্তক ভদ্র, বিনয়ী, স্বল্পবাক এবং মেধাবী মনে হয়েছিল আমার তাকে দেখে। যা সাধারণত খুব কম বাঙালি বড় ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়, আমার অভিজ্ঞতায় দেখিনি। সবাই ব্যস্ততার ভান করেন, না হয় আমলেই নিতে চান না।
যতটুকু দেখেছিলাম, জেনেছিলাম ততটুকুই ক্ষণস্থায়ী সম্পর্ক ছিল হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সঙ্গে। ততটুকুই স্মৃতি। তার মহাপ্রয়াণে নিবেদন করি গভীর গভীর শ্রদ্ধা।