রন্ধন বন্ধন নন্দনতত্ত্ব ॥ দিলারা মেসবাহ


শুরু করি রবিঠাকুরের পঙক্তি দিয়ে ‘বাসনার সেরা বাসা রসনায়।’
ব্যাপারটি আদতেই যথার্থ।ভোজনরসিক বাঙালি। জানেন বা মানেন রান্নার যাদু দিয়ে মানুষের মন ছোঁয়া যায়। পন্ডিতজনের ভাষ্য।

শত সহস্র অযুত নিযুত বছরের পরিক্রমায় বাঙালির খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠেছে।বাংলার ভূখণ্ডে হানা দিয়েছে পারস্য,পর্তুগিজ,ওলন্দাজ,ফরাসি, চীনা,বিলাতি,মোঘল,আফগান আরব,তুর্কি,পার্সি।রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য ইত্যাদির কারণে দীর্ঘদিন শ্যামল মাটির দেশে মৌরুসি পাট্টা দাখিলের ধান্দায় মত্ত থেকেছে। সে কারণে বাংলার ভাষায় অবলীলায় প্রবেশ করেছে বিদেশি শব্দ, তেমনি আচার-আচরণ ও খাদ্যাভাসে যুক্ত হয়েছে মিশ্র ধারা।যে কারণে বাংলা শঙ্কর জাতি,শঙ্কর ভাষা আর বিচিত্র খাদ্যাভাসে সমৃদ্ধ। যুগে যুগে ভিনদেশি রান্নার স্বাদ নিতে বাঙালি কার্পণ্য করেনি।

ভেতো বাঙালি-শব্দ দুটি নেতিবাচক ইতিবাচক দুই ধরা যায়। গবেষকদের মতে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে ধান আমদানি করা হতো। এরপর কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে ভাতের ডিবি বাঙালির পাতে। চতুর্দশ শতকের ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’ গ্রন্থে পাই,
‘ওগগরা ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সজুক্তা
মৌইলি মচ্ছা নলিতা গচ্ছা দিজ্জই কান্তা খা (ই) পুনবত্তা।’
এক

বাংলা করলে এরকম দাঁড়ায়,
রমনী কলাপাতায় গরম ভাত,ঘি,মৌরলা মাছ আর নলিতা মানে পাট শাক পরিবেশন করে স্বামীকে খাওয়ায়, সেই স্বামী ভাগ্যবান।
বুঝতে বাকি রইলো না চিরকাল স্ত্রীটি স্বামী সেবায় ‘অনন্য’। সে যাক,নৈষতচরিতে ভাতের বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়,
‘পরিবেশিত অন্ন হইতে ধোঁয়া উঠিতেছে। তাহার প্রতিটি কণা অভগ্ন,একটি হইতে আর একটি বিচ্ছিন্ন।সে অন্ন সুসিদ্ধ সুস্বাদু আর শুভ্রবর্ণ,সরু এবং সৌরভময়।’

চতুর্দশ শতকের চর্যাপদের বৌদ্ধ গানে পাওয়া যায়, ‘হাড়িত ভাত নাই নিতি আবেশি।’
বোঝা গেল বাঙালির পাকঘরে ভাতেের বলকের সুবাস বহুকাল ধরেই আনাগোনা করছিল। ভাতনামা যখন শুরু হয়েছে, তখন আজকালকার রসুইঘর থেকেও ঘুরে আসা যাক।মূল কথা ব্যাঞ্জনাদি রাঁধার আগে ভাত রান্নায় এলেম আবশ্যক। সুন্দর ফুরফুরে লাসা লাসা ভাত
রাঁধতে সব রাঁধুনির হাতযশ সমান নয়। কেউ রাঁধে দলা দলা,কেউ জাউ,কেউ শক্ত লোহা।

আগে যে বিবরণ রয়ে গেছে, প্রতিটি দানা থাকবে অভিন্ন, কিন্তু সুসিদ্ধ সুস্বাদু সুবাসিত। ধোঁয়া ওঠা নিমফুল ভাত পাতে পড়লে আহার আনন্দময়। একই কথা পোলাও রান্নার ব্যাপারে। চাল ভালো করে পানি ঝরিয়ে মমতাময় হাতে ভালোভাবে ঘিয়ে বা তেলে কষিয়ে
নিতে হবে।বেশি হলে প্লাস্টিক কম হলে দলা দলা। মনে রাখা অত্যাবশ্যক রাঁধুনি তিনি যতই দরের হোক না, হাজারো ময়মশল্লার সাথে আর একটি মশল্লা জরুরি সেটা হলো ভালোবাসা মমতা।ঘি মাখা গরম ভাতের কদর বহু যুগের।

ভাতের গল্প ফুরাবে না।আবারও ফিরবো ভাতের বলকে,সুবাসে।
শাকপাতা ও অন্যান্য ব্যঞ্জনের সমাহার না হলে ভাতের স্বাদ পূর্ণ হয় না। মুকুন্দরামের
‘চন্ডীমঙ্গল’ কাব্যে আমরা তারই আভাস পাই।
‘নটে রাঙা তোলে শাক পালঙ্গ নলিতা
তিক্ত ফল তার শাক কলতা পলতা
সাঁজতা বনতা বন পুঁই ভদ্র পলা
নটুয়া বেথুয়া তোলে ফীরে ক্ষেতে ক্ষেতে
মহুরী শুলকা ধন্য ক্ষীর পাই বেটে।’

আহারের শুরুতে শাকপাতা ভাজা,কখনো করল্লা,নানা পদের ভর্তা ইত্যাদির সমাহার থাকতো।এখনো এ চল আছে বৈকি।আহারের শেষে টকদই, পায়েস যেন না হলেই চলে না। মজার বিষয় প্রাচীন কোনো গ্রন্থ বা নথিতে ডালের হদিস পাওয়া যায় না। পরবর্তী সময়ে ডাল অপরিহার্য হয়ে ওঠে বাঙালির পাতে।হাপুস হুপুস ঘন ডালের স্বাদ অমৃতের প্রায়। ধারণা করেন ইতিহাস বেত্তারা দক্ষিণের সেন রাজবংশ আর উত্তর পশ্চিম থেকে ইসলামের আবির্ভাবের সাথে ডাল উঠে রাঁধুনীর উনুনে।

‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’ নামের এক আধুনিক গ্রন্থে অড়হর, মুগ, মসুর, কলাই ইত্যাদি ডালের রন্ধন পদ্ধতির বিবরণ পাওয়া যায়। গাঁটছড়া বেঁধে সবজি এলো বাঙালির পাতে। নিরামিষ ভোজীদের তো নিরামিষ ছাড়া চলেই না।‘মনসামঙ্গল’ও ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে এহেন সবজির বাকি নেই যা বাঙালির সপ্ত ব্যঞ্জনে বা ষোড়শ ব্যঞ্জনের তালিকায় ঠাঁই পাইনি। আলু,পটল,ঝিঙে,উচ্ছে,বেগুন, শিম, কাঁচাকলা,কাঁঠালবিচি,কুমড়ো ইত্যাদি তো আজও বাঙালির হেঁশেলের ডালার পূর্ণতা।টমেটো ছাড়া এখন চলেই না বাঙালির। মজার বিষয় এই আলু এসেছে সপ্তদশ শতকে। কাঁচালঙ্কা, টমেটো। গ্রামে গঞ্জে এখনো কেউ কেউ টমেটোকে বলে ‘ বিলাতি বাইগুন’। পর্তুগিজদের আগমনে আলু, টমেটো বাঙালির খাদ্য তালিকা সমৃদ্ধ করলো।

মাছে ভাতে বাঙালির রসনার কথা সুবিদিত। নদী মেখলা বাংলাদেশের খানে ওয়ালারা মৎস্য বিহনে নাচার।বহুকাল থেকেই রাঁধুনিরা মাছের বিবিধ পদ রান্না করেন।দৈনন্দিন আহারে আর উৎসবে।পাহাড়পুর, ময়নামতির টেরাকোটা ফলকে মাছের চিত্র পাওয়া যায়। এমনকি
গ্রামীণ রমনীরা নকশিকাঁথার ফোঁড়ে দিব্যি ফুটিয়ে তোলেন মাছ, যাঁতি, পাখি, ফুল ইত্যাদি। এসবই বাঙালির যাপিত জীবনের আয়না।

মধ্যযুগে নানা মঙ্গলকাব্যে লৌকিক যাপনে মৎস্য ভোজনের চমকপ্রদ বিবরণ রয়েছে। রুই, কাতলা, চিতল, মাগুর, শিঙ, চিংড়ি, পাবদা, শোল, বাইম, নলা, টাকি ইত্যাদি মাছের নাম আছে।ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে চিংড়ি, কচ্ছপের ডিম,ভেটকি ইত্যাদি অনেক মাছের উল্লেখ আছে। শুটকি মাছের কদর বহু যুগের।

ষোড়শ শতকের বিজয়গুপ্তের রচিত মনসামঙ্গলে মাছ রান্নার হদিস মেলে। কই মাছ রান্না হতো আদার রসে।রুই মাছ মজাতে কলতার আগা।খরসুনে কড়া ঝাঁঝের সরষের তেল। মধ্যযুগ থেকেই গরু, খাসি, ভেড়া, হরিণের মাংস ভোজন রসিকদের রসনায় তৃপ্তি দিয়েছে।

চর্যাপদে উল্লেখ আছে, ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’। হরিণের মাংসের লোভে বন জঙ্গল তছনছ করে স্বাদু হরিণ নির্বিচারে শিকার করা হতো।আদি গুহাবাসী পূর্বপুরুষরা পশু শিকার করে আগুনে পুড়িয়ে খেতো।এখনো নির্বিচারে পাখি শিকার হয়ে থাকে। যদিও পাখি হরিণ ইত্যাদি শিকার আইনত অপরাধ।

বিজয়গুপ্তের ‘মনসামঙ্গলে’ উল্লেখ আছে, ‘মাংসেতে দিবার জন্য ভাজে নারিকেল, ছাল খসাইয়া রান্ধে বুইড়া খাসীর তেল’ শুধু কি এতেই খান্ত? বেজি, সজারু, কাঁকড়া,শামুক, শুকর, হাঁস ইত্যাদিও রাঁধা হতো। আয়েশ করে ভোজের আয়োজন হতো। মুসলিমরা শুকর খেতো না, ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে।সনাতন ধর্মের বিশ্বাসীরা গরুর মাংস নিসিদ্ধ মানে।আবার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা জীব হত্যা মহাপাপ মেনে নিরামিষভোজী। মুরগি সকলের আরাধ্য খাদ্য। নানাভাবে মুরগি রাঁধেন রাঁধুনিরা। মোঘলাই খানায় ঘি,আলুবোখারা, জয়ত্রি,জায়ফল,স্যাফরন ইত্যাদি হরেক পদের মশল্লার ব্যবহার হতো।যা নাকি সুবাসিত ও স্বাদে অনন্য। কিন্তু স্বাস্থ্যকর নয়।এখনো মুরগি মোসাল্লাম, কাচ্চি বিরিয়ানি ছাড়া জামাই আদর সম্পূর্ণ হয় না অনেক পরিবারে।

এবার আসা যাক মিস্টান্ন মহলে।কবেকার ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে পাওয়া যায় পাতাপিঠা, দুধলকলকি, ক্ষীরখণ্ড, চন্দ্রপুলি,পায়েস ইত্যাদি। খেজুর, আখের রসের গুড়, পাটালি,পানীয় খুব আদরের ঘরে ঘরে। রসগোল্লা এখনো জিভে জল আনে বাঙালির। সন্দেশ তো আর এককাঠি সরেস।কাঁচাগোল্লার অপরাধ কী! নাটোরের এই মিস্টান্ন মশহুর। তেমনি মন্ডা, রসকদম, রাঘবের সন্দেশ, রসমালাই, ছানামুখি এ ফিরিস্তি শেষ হবার নয়।

ফিরে আসা যাক জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে। শিল্প-সংস্কৃতি সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে ঠাকুর পরিবারের তুলনা হয় না। আর বলতেই হবে ভোজনরসিক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সমুজ্জ্বল নারীরা রন্ধন ইন্ধন বিকশিত হয়েছিল মূলত বিশ্বকবির উসকানিতে। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী দেশি-বিদেশি মজাদার খাবার খেয়ে রেসিপি টুকে রাখতেন।পূর্ণিমা ঠাকুর লিখলেন ‘ঠাকুর বাড়ির রান্না’। ঠাকুর পরিবারের রান্নাঘর তেলচিটে রসুই ঘর নয়,বরং শিল্পঘর।রবীন্দ্রনাথ নিজেও ছিলেন ভোজনরসিক।মৃণালিনী দেবীর পাশে মোড়ায় বসে নতুন রান্নার ফরমায়েশ দিতেন।

কাসুন্দি দিয়ে পাটপাতার ঝোল,ছোলা ও ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক,পুঁই পিটুলির চচ্চড়ি, সজনে শাক ভাজা রসুন দিয়ে। কচি লাউডগা দিয়ে মটর ডাল, মসুর ডালের বড়া দিয়ে মোচা ঘণ্ট! এখানেই শেষ নয় ডুমুর আলুর রসা,বকফুল আর পাটপাতার বড়া,কাঁচা ইলিশের ঝোল,রুই মাছের বাটি চচ্চড়ি ইত্যাদি। মৃণালিনী দেবীর মুনশিয়ানা ছিলো পান সাজানোত বড়ি,কাসুন্দি, নানান আচার দিতে তার দক্ষতা ছিলো। মানকচুর জিলাপী, দইয়ের মালপো,চিঁড়ের পুলিপিঠে তাঁর যত্নে মমতায় অসাধারণ স্বাদু হয়ে উঠতো। মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সের পাঁচটি সন্তানের জননী লোকান্তরিত হলেন।

তরকারিতে মিস্টি দেওয়ার চল প্রবর্তিত হয়। প্রজ্ঞা সুন্দরীর ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’ গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ বলে বিবেচনা করা যায়।
রবি ঠাকুরের পঞ্চাশতম জন্মদিন উপলক্ষে ফুলকপি,খোয়া ক্ষীর,বাদাম, কিশমিশ,জাফরান সোনা রুপার তবক দেওয়া বরফি বানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘কবি সংবর্ধনা’ বরফি। খেজুরের পোলাও, লঙ্কাপাতার চচ্চড়ি, রসগোল্লার অম্বল,বিটের হিঙ্গি,পানিফলের ডালনা,ঝিঙাপাতার
পোড়া,মিঠা-দই-মাছ,ঘণ্ট ভোগ,কচি পুঁইপাতা ভাজা,কাঁচা তেঁতুলের সরস্বতী অম্বল, আমলকি ভাতে,পেঁয়াজের পরমান্ন,কই মাছের পাততোলা,কাঁকড়ার খোলা চিঠি,মাংসের বোম্বাইকারী ইত্যাদি।

রবি ঠাকুরের প্রিয় বৌঠান খুব মিহি করে সুপারি কাটতেন প্রতিদিন। পায়েস ইত্যাদি বাটিতে সাজিয়ে গোলপের পাপাড়ি ছড়িয়ে দিতেন চারপাশে। ঢাকনা দিতেন বর্ণিল নক্সি কাপড়ে। নান্দনিক সাজে কারুখচিত রেকাবিতে করে পাঠিয়ে দিতেন দহলিজে।

তেতলার ছাদে গড়ে উঠেছিল নন্দনকানন। মাদুরের উপর তাকিয়া। রূপার রেকাবিতে ভিজে রুমালের উপরে বেলফুলের গোড়ে মালা।গ্লাসে বরফ জল,বাটিতে সাজানো সাঁচি পানের সবুজ। এ সবই কাদম্বরী দেবীর শৈল্পিক আয়োজন।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে,১৮৩১ সালে বিশ্বেশ্বর তর্কালঙ্কার ভট্টাচার্যের ‘ পাক্ রাজেশ্বর’, ১৮৫৮ সালে গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশের ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’ গ্রন্থগুলো জনপ্রিয় হয়ে ছিলো। আরও ছিলো বিপ্রদাসের ‘পাক প্রণালী’।
রেনুকা দেবীর চৌধুরানীর ‘রকমারি নিরামিষ রান্না’, ‘আমিষ খণ্ড’।

বাঙালি মাইক্রফোন ও কলম দখলে পেলে ব্যক্তিগত বিষয় ব্যক্ত করতে মুখিয়ে থাকে! ইলিশ মাছের রূপকথার স্বপ্ন বিভোরতায় স্মৃতি কাতর হতেই হয়! রূপসী, গুণবতী, প্রেমময় হিলশা কৈশোরকালটা যাদুর মায়ায় দিশেহারা করে রেখেছিল।পদ্মার তেল চুকচুকে সুন্দরী ইলিশ আসতো বাড়িতে। মা বলতেন এই মাছ কিন্তু হালকা হাতে পলকা ধোলাই হবে।অন্য মাছের মতো আছড়ে পিছড়ে লবণ,লেবু ঢলে ধোওয়া পাখলা করা যাবে ন। সব ভালো রন্ধনেই চাই প্রেয়ময় মনটি। ইলিশ রাঁধায় চাই তরতাজা ভালোবাসা।যদি সর্ষে ইলিশ খেতে বাসনা জাগে তবে রূপো চকচকে-ভেলভেটি ইলিশের গাদা,পেটে কিছুটা পিঁয়াজ তেলে কষিয়ে সরষে বাটা মাখিনো ইলিশের ফালি আলগোছে পিঁয়াজের বিছানায় শুইয়ে দিন।অতঃপর নুন বেশ কিছু কাঁচা লঙ্কা আড়াআড়ি ফেরে ছেড়ে দিন।খুন্তি বেশুমার চালাবেন না। ননীর শরীরে সইবে না। মিনিট কয়েকের মধ্যে আপনার সার বাড়ি ইলিশের আতরে ম’ ম’ করবে।রসুইয়ের চোরা খোপ থেকে পাশের বাসার ঘরেও ঢুকে যেতে পারে।মন চাইলে সুন্দর একটি বাটিতে তিন চার টুকরো সাজিয়ে ‘বৌঠানের’ মতো আপনার টবের একটি গোলাপ দিয়ে নকশি ঢাকনায় ঢেকে পাঠিয়ে দিন। প্রতিবেশী চমৎকৃত হবেন বৈকি। মমতার বন্ধন পাকা হতে পারে! ইলিশ পাতুরি, ইলিশ ভাপে, ইলিশ আনারস, ইলিশ কচি লাউ, ইলিশ লতি চচ্চড়ি, ইলিশ পোলাও। আহা ইলিশ নিয়ে মহাকাব্য।

পোয়াতি ইলিশের ঝাঁক যখন নোনা পানি ঠেলে মিঠা পানিতে বাপের বাড়ি নাইয়র আসে তখন জাল ভরে ইলিশ ধরা চলতে থাকে।ডিম ভরা ইলিশ রাঁধতে বসলে মন বিষণ্ন না হয়ে যায় না। জাটকা কিনবেন না কস্মিন।ওরা নেহায়েত শৈশবের খেলায় বিভোর।

মধু মাস চলছে।জামাই আদরের মোক্ষম সময়! ঘন সরভাসা দুধ,কয়েক জাতের আম,লিচু,কাঁঠালের কোয়া আলাদা আলাদা বর্তনে পরিপাটী সাজানো। জামাইয়ের জিভ সরসর করলেও নিরাসক্ত চাহনি।মা কবে বলেছিলেন,বাবারে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে খাবারের দিকে হামলে পড়বে না।কাসুন্দি মাখানো আমও থাকে এককোণে।

আমরা আম জামের,লিচুর রসে বশে মজে কৈশোর কাটিয়েছি।এখন যা কিনা।রূপকথার মায়া।আম কেন সব জাতের ফলফলাদি খাওয়ার আগে ফরমালিন মুক্ত করার সাধনায় অর্ধেক বেলা কাবার। নতুন লাল চালের জাউ,ঘন দুধ,পাটালিগুড় বা শবরি কলা মাঝে মধ্যে এ নাশতাও চলত।
বিংশ শতাব্দীতে আটার রুটির চল শুরু। আমরা কাগজের মতো পাতলা আটার রুটি,সুজির মোহনভোগ বা চিরল চিরল করে কাটা আলুর মচমচে ভাজা দিয়ে প্রাতঃরাশ করতাম।কোনদিন গাওয়া ঘিয়ে মচমচে পরোটা বা ফুলকো লুচি মুরগি ভুনা হতো।

সকালের নাশতায় ভুনা খিচুড়ি কালে ভদ্রে হতো।চা পানে কৈশোর পর্যন্ত বিধিনিষেধ বলবৎ ছিলো।চা বুঝি মদ্যপানের শামিল! অথচ মা,নানিমা,ফুপুমা ঘন দুধের চা পান করতেন আয়েশ করে,মচমচে মুড়ি বা মুড়মুড়ে টোস্ট দিয়ে। দুপুরের আহার বেগুন ভর্তা,বেগুন চাক ভাজা,পটল ভাজা,নানা পদের শাক ভাজা ইত্যাদি দিয়ে বিসমিল্লাহ। তারপর কৈ,রায়েক, নারকেল চিংড়ির মালাইকারি,মুরগির ঢিলেঢালা ঝোল,কোনদিন খাসি,গরু।মুরগির সালুনে মায়ের কারিশমা দেখতাম,কিন্তু ঐ জাতীয় ‘ না হইলেও চলে’ পদ্ধতি কস্মিন মগজে ধারণ করিনি।কেননা গ্যাঞ্জাম।আমরা করি শর্টকাট।

মা পিঁয়াজ,তেজপাতা,জিরা তেলে ভেজে পাটায় পিষে মুরগির ঝোলে মিশিয়ে দিতেন।কী যে অপূর্ব স্বাদ হতো। পোলাও রান্না? হায়রে আয়োজন। পাতিলে আখনির পানি,তাতে পুটলি বাঁধা নানা পদের মশল্লা।নির্যাসমিশ্রিত সেই ফুটন্ত তৈরি।ঝরা দেওয়া পোলাওর চাল ঘি মৃদু আঁচে ভুনা।চাল খানিকটা মচমচে ভাব আসলেও ঐ পানি মাপমতো ঢেলে মোটামুটি এটেনশন হয়ে থাকতে হয়।ঝরঝরে সুবাসিত পোলাও তৈরি। আঁচের দিকে খেয়াল রাখতে হয়।প্রথমে খানিকটা চড়া, পরে ঢিমে।নামানোর আগে এক ডাব্বু গাওয়া ঘি।চিনি দিয়ে চটকানো মুচমুচে বেরেস্তা ভাজা ছিটিয়ে দিয়ে পরিবেশন। ক্ষীর রান্না হতো কমপক্ষে তিন চার কে.জি ঘন দুধের সায়রে পাটালিগুড় আর কয়েক মুঠি সুগন্ধি চাল ফেলে। কিন্তু ভালোবাসা বলবৎ রাখতে হতো।নাড়তে হবে,হালকা হাতে।যেন নিচে ধরে না যায়।মধ্যবিত্ত পরিবারের কমবেশি অনেকেই এই জাতীয় সুস্বাদু রান্নায় অভ্যস্ত।তারপরেও খেয়েছি এমন পায়েস,যাকে দুধভাত হিসাবে ধরা যায়।

ঈশ্বরী পাটনি কতোকাল আগে প্রার্থনা করেছিলেন, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। এ প্রসঙ্গে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘দুধভাতে উৎপাত’ গল্পটি মনে পড়ে গেল।সৈয়দ আলী আহসানের একটি রন্ধন বিষয়ক গ্রন্থ আছে। ‘দেশবিদেশের রান্না’! রসনার ফিরিস্তি অনেক অনেক লম্বা। মনে পড়ে রসনার রাশি দিয়ে বাঁধা যায় শত্রু মিত্রের অটুট বন্ধন।নান্দনিকতার প্রকৃষ্ঠ পালা।রাঁধার সাথে বাড়ার প্রেমময় গাঁটছড়া। পরিবেশনের সৌন্দর্য রসনার স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। আবার এও ঠিক অতিরিক্ত সাজসজ্জার প্রদর্শনীতে রসনা পানসে হয়ে যেতে পারে!

বেগম রোকেয়াকে টেনে আনতে হলো।তাঁর মতে মহিলারা যেন ৪০০ রকমের হালুয়া ইত্যাদি শিখে গৃহিণীজীবন শুরু করে মরণের মধ্যে দিয়ে বাবুর্চি জীবন সমাপ্ত করেন। রবিঠাকুর লিখেছেন, ‘বাসনার সেরা বাসা রসনায়’!…রসনার স্বাদে জীবন হোক আনন্দময়।সেটা হতে পারে নয়া আলু ভর্তা,গাওয়া ঘি আর ঝরঝরে গরম ভাতে।কৃষকের পান্তায় পিঁয়াজ, পোড়া শুকনো মরিচের লালিমায়।
সুকুমার রায় দিয়ে বিদায় নিতে হয়,
এতকিছু খেয়ে যদি নাহি ভরে মনটা
খাও তবে কচু পোড়া খাও তবে ঘণ্ট।
তারচেয়ে বরং খাওয়া যেতে পারে,পাউরুটি আর ঝোলা গুড়।