আমি স্বপ্ন দেখছি, স্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছি: বুকারজয়ী ডেভিড


‘অ্যাট নাইট অল ব্লাড ইজ ব্ল্যাক’ পেলো ইন্টারন্যাশনাল বুকার প্রাইজ

শিল্পসাহিত্য পাড়ায় আরেক আনন্দ সংবাদ। ফরাসি লেখক ডেভিড ডিওপ তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘অ্যাট নাইট, অল ব্লাড ইস ব্ল্যাক’ ২০২১ সালের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পুরস্কার বুকার লাভ করেছে।

পুরস্কার প্রাপ্তিতে লেখকের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হলো, ‘আমি আনন্দিত এবং এখনো মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি-স্বপ্ন থেকে আমি জেগে উঠেছি।’

২০১৮ সালেও একই উপন্যাসের মাধ্যমে ডেভিড ডিয়োপ ফরাসি দেশের নামি পুরস্কার প্রিক্স গনকর্ট ডেসে লাইসিন অর্জন করেছিলেন। তিনিই প্রথম ফরাসি এবং আফ্রিকান যিনি এই উপন্যাসটি অর্জন করেছেন। উপন্যাসটি ফরাসি Frere d’ame থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন আনা মশোভাকিচ।

উল্লেখ্য গত বছর (২০২০) সাহিত্যে বুকার পেয়েছিলেন ডাচ লেখক Marieke Lucas Rijneveld তার The Discomfort of Evening উপন্যাসের জন্য।

১৯৬৬ সালে জন্ম নেন ডেভিড ডিয়োপ। ছেলেবেলা কাটে সেনেগালে। তারপর ফ্রান্সে জীবন শুরু হয়। সতের এবং আঠারো শতকের ফরাসি এবং আফ্রিকার সাহিত্য নিয়ে তিনি পড়াশুনা করেন এবং কলেজে অধ্যাপনা করেন।

নিউইয়র্ক সময় জুন ৩, সকাল দশটায় উপন্যাসটি নিয়ে নামকরা রেডিও চ্যানেল NPR(National Public Radio) ব্যাপক আলোচনা হয়। আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন বিখ্যাত সাহিত্য সমালোক লিলি মেয়ার, ব্রায়ান লিয়ার।

ডেভিড ডিওপ ও  অনুবাদক আনা মশোভাকিচ

 

 

 

আলোচক লিলি উপন্যাসটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে যেয়ে বলেন, ‘বিস্ময়কর একটি উপন্যাস। উপন্যাসটির গদ্য ঝরঝরে। পড়লে মনে হবে যেন যুদ্ধক্ষেত্রেই আছি’।

উপন্যাসটি সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমস মনে করে, ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শত বছর পরে একজন মহৎ আফ্রিকান লেখক কুতসিৎ মানব ইতিহাসের উপর তার প্রশ্নগুলো একটি উপন্যাসের মাধ্যমে রাখতে পেরেছেন।’

চলুন এবার উপন্যাসটি সম্পর্কে একটু জানা যাক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এক সুনসান সকালে ফরাসি কমান্ডার ক্যাপেটন আরমান্দ তার সেনাবাহিনীকে জার্মানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশ মানতে ফরাসি সেনাবাহিনী জীবনবাজি রেখে ঝাপিয়ে পরে। ফরাসি পতাকা হাতে নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেয় সেনেগালের দুই তরুণ বন্ধু আলফা নাদিয়ী এবং মেডেমবা ডিয়োপ। মাডেমবা যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়ানকরকম আহত হন। আহত মাডেমবা তার বন্ধুকে অনুরোধ করে গুলি করে তাকে হত্যা করে তাকে এই মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে। ছেলেবেলার বন্ধু আলফার সামনেই তার বন্ধু মেডেমবার এই মৃত্যুর দৃশ্য আলফাকে ভয়াবহ রকমভাবে মানসিকভাবে কাবু করে। কারণ আলফা শুধু তার বন্ধুই ছিল না বরং তার সঙ্গে ছিল আত্মিক সম্পর্ক। আলফার ভাষায়, ‘I can think what I want. But I won’t tell-the depths to which the war drove me…the weight of shame…the day Mademba Diop died’।

যুদ্ধের ভয়াবহতায় আলফা ভীতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আলফার মনোজগৎে যুদ্ধের এই ভয়াবহরূপ নানা ভাবে আঁচর কাটতে শুরু করে। আলফা শুধু ভাবে, ‘এই মানুষ মারা যুদ্ধ দিয়ে আসলে কি ফায়দা’। তার বিবেক তখন অন্য কথা বলে! যুদ্ধের নামে চারদিকে আলফা শুধু কিছু ক্ষমতার জন্যে লালায়িত মানুষের মতো দেখতে পায়। আলফা স্মরণ করে তার অতীত জীবনের কথা। সেই সেনেগালের ছোট গায়ে তার বাবার কথা। তার মা সাধারণ মাঠে ছাগল চড়াতেন। কত শান্তি ছিল তার অতিত জীবনে। আলফা তার আত্মপরিচয়ের খোঁজে নিজের ভেতর ডুব দেয়। কিন্তু আলফা এ কথাও জানে যে সে তার অতীতকে আর খুজে পাবে না। যুদ্ধে সে সব হারিয়েছে। এই তথাকথিত আধুনিক সভ্য সমাজ এবং রাষ্ট্রে আলফা তার অতীতকে খুঁজে বেড়ায়।

উপন্যাসে দেখা যায়, সেনেগালের বাসিন্দা আলফা নাদিয়ীর যুদ্ধে অস্ত্রচালনায় পুর্বে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। ফরাসি সরকারের নির্দেশে সে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফ্রান্স সরকারের বিশ্বযুদ্ধে ‘চকোলেট’ সেনাবাহিনীতে নাম লেখায়।

উপন্যাসটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের হারিয়ে যাওয়া একটি বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। আলফার মুখ দিয়ে আমরা যুদ্ধের ভয়াবহ রূপটিকে দেখতে পেয়েছি। একটি যুদ্ধের আড়ালে থাকে আরেকটি যুদ্ধ। লেখক সেই যুদ্ধকে সাহিত্যের ভাষায় রূপ দিয়েছেন। উপন্যাসে বিভিন্ন সময়ে অনেক মেটাফর ব্যবাহৃত হয়েছে। বিশেষ করে আলফা রক্তক্ষয়ি যুদ্ধে তার বন্ধুর এভাবে চলে যাওয়াকে মানতে পারেনি। কারণ তার কাছে এই হত্যাকে অমানবিক মনে হয়েছে। বা বলা যায় অনৈতিক মনে হয়েছে। তার বন্ধুর মৃত্যুতে তাকে আরও বেশি প্রতিশোধ পরায়ন মনে হয়েছে।

উপন্যাসটির পটভুমি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হলেও মূলত এটি একজন সৈনিকের সমবেদনায় পিষ্ঠ মনস্তাত্বিক এবং মানসিক যন্ত্রনার চিত্রপট। উপন্যাসটি ইউরোপের দেশগুলোর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে পারস্পরিক ক্ষমতার ভাগাভাগি, ঔপনিবেশিক মানসিকতা, মানবতার পতন এবং যুদ্ধে মানসিক বিকলাঙ্গ রূপকে ধারণ করেছে। পাশাপাশি ফরাসিদের অসভ্যতা, ঔপনিবেশিক মানসিকতা, আফ্রিকার মানুষের প্রতি বর্বর আচরণ এই উপন্যাসে ফুটে উঠেছে। তথাকথিত এই সভ্যতার ধারক যারা মূলত সভ্যতার টুটি চেপে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে উপন্যাসটিতে আলফার মুখ দিয়ে সেই প্রতিবাদী ভাষা বেড় হয়ে এসেছে। আলফা বলছে, ‘I am father and son. I am assassin and judge. I am the sowing and the harvest. I am mother and daughter. I am night and day. I am fire and the wood it devours. I am innocent and guilty. I am the beginning and the end. I am the creator and the destroyer. I am double।’

ফ্লাসব্যাকে দেখতে পাই আলফার সেই ছেলেবেলা, তার ছোট ছিমছাম একটি সুখী পরিবার। অথচ সে এখন কিনা কুতসিৎ যুদ্ধে লিপ্ত! ডিয়োপ আলফার জবানে গোটা পৃথিবীর নিপিরীত শোষক গোষ্ঠীর মনোবেদনার কথাই শুধুই শোনাননি পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বের কুতসিৎ রূপটিও তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। আলফা বলছেন, I watch him die a little, then I slit his throat, cleanly, humanely. At night, all blood is black. অনেক রূপক বর্ণনার কারণে উপন্যাসটির ভাষা আরো সুন্দর এবং হৃদয়গ্রাহী হয়েছে।

উপন্যাসটিতে লেখক খুব মুন্সীয়ানার সাথেই যুদ্ধকে প্রশ্ববিদ্ধ করেছেন, ঔপনেবিশিক মানসিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, মানবিকতাকে প্রশ্ন বিদ্ধ করেছেন এবং সর্বপোরি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় যারা অংশগ্রহণ করছে তাদের মানসিক বিকলাংগকেও তিনি আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। উপন্যাসটিতে শুধু যুদ্ধের ভয়াবহ রূপটিকে ধারণ করা হয়নি পাশাপাশি সেই যুদ্ধের আড়ালে কুৎসিৎ রূপটাও সমানভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

উপন্যাসের শেষ দিকে আমরা দেখতে পাই কীভাবে শাষকের বুটের নীচে মানবতা লুন্ঠিত হয়। ইতিহাসের অন্তরালের যে ঘটনা আমরা জানি না, যুদ্ধের যে কুৎসিত রূপ আমরা দেখতে পাই না সেই দৃশ্যকেই ডিয়োপ তার উপন্যাসের মাধ্যমে তুলে এনেছেন। আলফা বলেন,
‘I am not concerned with my trenchmates…what I want is to fight face-to-face…I always returned after battle with an enemy rifle and the hand that went with it…”. Trophies…I was lauded…until the fourth rifle and hand…now shunned, feared by my war brothers…I became untouchable, a soldier sorcerer.”

উপন্যাসটি মানবতার কথা বলে, মানুষের কথা বলে। পাশাপাশি এই উপন্যাসটি ফ্যাসিবাদ এবং ঔপনিবেশিকবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক দাম্ভিক প্রতিবাদ। সাহিত্য হোক মানবতার কণ্ঠসর। চিয়ার্স ডেভিড ডিওপ ।