অযাচিত ভাবনা ॥ শামীম আজাদ


বাংলাদেশের এক নগন্য কবি আমি। থাকি বহু দূরে বিদেশ নগরে এক ভিন্ন ভাষাধারী জীবনখনিতে। কাব্যকর্ম ও লেখালেখিই আমার জীবিকা এবং জীবন। এ বিলেতে আমার এ শিল্পযাত্রারও হয়ে গেল তিরিশ বছর। দেশে আমার সাথীদের মধ্যে যাঁরা শীর্ষস্থানে ছিলেন তাঁদের অনেকেই আর বেঁচে নেই।আমাদের প্রজন্মে যেন মড়ক লেগেছে।

দু-টো টিকা পেয়েছি। টুকটাক শারীরিক সমস্যা আছে। সে তো থাকবেই। সেসব মনেও থাকে না। তবে যেদিন সন্ধ্যায় আমার ব্যালকনির ওপারে জলপাই রঙের সিকানোর গাছটি ঘন হয়ে যায় আর ওল্ডহোমের সামনের বাতিটি জ্বলে ওঠে- আমি কত অযাচিত কথা ভাবি।
ত্রিশ বছর ধরে একটি প্রশ্ন শুনতে হয়েছে, আমি কেন দেশে থাকলাম না, থাকলে অমুক লেখক তমুক লেখকের পরই আমার নাম উচ্চারিত হতো। দেশের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকটি পুরস্কার অনেক আগেই পেতে পারতাম। কিন্তু আমি বলি এসব ক্ষেত্রে যতদিন অবদান নয় মূলত ব্যক্তির ‘অবস্থান’ই বিবেচ্য থাকবে – তখন আমি কেন আমার চেয়েও অনেক অনেক নামকরা এ গুণীজন যাঁরা বিদেশ থেকেই দেশের জন্য ও দেশে অবদান রেখে চলেছেন তারাও কোন কিছুই পাবেন না। আমার তখন নিরোদ সি চৌধুরীর কথা মনে পড়ে।

‌‘আমার বাঙালি জীবন অবস্থা চক্রে বিদেশে- নির্বাসনেও বলা চলে শেষ হইতে চলিয়াছে। কিন্তু সেটাও আমার জীবনে ব্যর্থতা না আনিয়া সার্থকতাই আনিয়াছে। বিলাতে বাস করিয়া আমি যেভাবে কাজ করিতে পারিতেছি (আমার ক্ষেত্রে যা যা করিতেছি) দেশে থাকিলে তাহা কখনই সম্ভব হইত না। ইহাই যদি যথেষ্ট না হয় আমি এটাও বলিতে পারি যে, বেশি ই পাইয়াছি। …… তারপর খ্যাতি বা সমাদর লাভ ও কম হয় নাই।… অবশ্য আমি একথা কখনই বলিব না যে, আমি আমার দেশবাসীর কাছ সমাদর পাই নাই, কিন্তু তাহা গোপনে অপ্রকাশিতভাবে। বিদেশে সে বিষয়ে আমার অনুমানের শরণ নিতে হয় নাই।’

জ্ঞানের মতোই সাহিত্য-জগতেও কোনো শর্টকাট সড়ক নেই। আরো কবি বলে কথা। একখানা উপন্যাস লিখে যে অর্জন সম্ভব একখানা কবিতায় হয় না। কয়েক খানায় ও না। আগে কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হয়। বিস্তর শুধু নয় পৃথিবীর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাঁক বদলে নিরন্তর লিখে যেতে হয় । তারপর লাগে পূর্ণাঙ্গ একখানা কাব্য গ্রন্থ। এবং তা যেন তেন নয়, তা হতে হয় বাছাই বা নির্বাচিত কবিতার। আমার এ ক্ষুদ্র জীবণে বাংলাদেশে কবি হিসেবে একটি অবস্থান অর্জিত হলেও, পঞ্চাশ বছর ধরে কবিতা লিখলেও বাংলা ভাষায় ও আমার তা নেই।

গতকাল ‘ব্রেডফোর্ড বার্ডস’ এ ইংরেজি কবিতা পরিবেশনের পর প্রশ্ন উত্তর পর্বে যখন বলেছি, আমার কোনো ইংরেজি কবিতা সমগ্র নেই – তরুণ শ্রোতা বিস্মিত হয়েছেন।

আমি বিশ্বের ও ইংল্যান্ডের বহু সংকলনে, আর্কাইভে, ইউটিউব, উইকিপিডিয়ায় এমনকি এ্যালেক্সার কণ্ঠে আমার পরিচিতি থাকলেও আমার একক কোন ইংরেজি গ্রন্থ নেই। সত্যি নেই।

শিল্পাঙ্গনের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বুঝি আমার কবিতা ইংরেজির জন্য নয় – আদৃত হয় বা হচ্ছে আমার কাব্য বিষয় ও বিনোদনে বাংলাদেশের সুগন্ধ ও স্বাদ এর কারণেই। আমি কবিতার সঙ্গে গল্প বলি , যাকে স্টোরি টেলিং বলে আরকি। বলতে দ্বিধা নেই ইংরেজিতে লেখার ক্ষমতা আমার প্রথম, প্রিয়তম, মাতৃভাষা বাংলার সমকক্ষ নয় – কোনদিন হবে বলে মনেও করি না। আমার পরের প্রজন্মের সে বালাই নেই। কিন্তু তাদের বাংলাটা আমার ইংরেজির সমমানের তো নয়ই বরং বেশ নিচে।কিন্তু তাতে কোন বাধা নেই যতক্ষণ ভিন্ন ভাষায় তাদের ‘বাংলা’ উপলব্ধির কথা লিখতে পারছে। জিয়া হায়দার, ঝুম্পা লাহিড়ী, তাহমিমা আনাম, ঈশিতা আজাদের মতো। এখন তাদেরই দরকার। আমি যে শুধু সেতু হয়ে ছিলাম তারও আনন্দ অপার।

এতদিনে অবেলায় বুঝি এ অক্লান্ত চলার সুফল দেশে না হলেও এদেশে তো এসেছে। আমার যা দেশ থেকে অর্জন তাই নিয়েই করেছি লড়াই। বাংলাদেশি বলে এ শিল্প অলিম্পিয়াডে হাঁটু ভেঙে পড়ে তো যাইনি! কালের মানদণ্ডে কোথাও না কোথাও তো দাঁড়িয়েছি।

ব্রিটেনে বাংলাদেশি বাইলিংগুয়াল কবি বা বেঙলি পোয়েট হিসেবে সার্চ করলে শীর্ষেই আসে আমার নাম। এই কোভিডকালেই ইংল্যান্ডের শিল্পসাহিত্য জগতের ১৩ জন ফ্রন্ট রানারের একজন ছিলাম আমি। আমাদেরকে বিশেষ সম্মান জানিয়েছেন প্রিন্স উইলিয়াম।স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয় প্রতিষ্ঠান ‘ন্যাশনাল লটারি’ দিয়েছে ‘আর্টিস্ট ইন দ্য কমিউনিটি’ অ্যাওয়ার্ড। গত বছর এথেন্সের এ পোয়েটস আগোরা’র আবাসিক কবির মর্যাদা অর্জন করেছি।এ বছর একটি পুরস্কার নিতে রূমানিয়া যাচ্ছি। যাচ্ছি আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলনে।

দীর্ঘ ও কঠোর শিল্প সাধনায় প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে এ অর্জন। যাত্রাপথে শিক্ষক, প্রশিক্ষক, মেন্টর ও বন্ধু পেয়েছি এদেশে শিল্প ও সাহিত্য জগতের ব্যক্তিত্বদের। মাইকেল রোজেন, বেঞ্জামিন জাফানায়া, ওয়েন্ডি কোপ,জন হোগলি, শ্যালি পম ক্লেটন, স্টিভেন ওয়াটস, ডানিয়েল ওয়েস্টবোর্ট, লিসা মীড, ডেনিস জোনস, সেফ টাউনসেন্ড, ডানিয়েল লামার্স, ম্যারি কুপার, পল বার্জেস, ডেবরা বেস্টউইক- এঁদের কাছে আমার সীমাহীন ঋণ। তিন দশকের এ যাত্রায় আমি ছিলাম একাকী শেরপা।

আমার মতো সমিল চেহারা, উত্তরাধিকার আছে এবং আমার আকাঙ্খার এ পথে হেঁটেছেন এমন কোনো অগ্রজ পাইনি। তাই এঁরাই ছিলেন আমার গুরু, সাথী ও বন্ধু। তবে দেশে ও বাংলা সাহিত্যে আমার যে অবস্থান আছে তা প্রিয় পাঠক, আপনাদেরই দান। আপনারাই আমার পুরস্কার, আমার অস্কার। আমার আর কিছু কি দরকার আছে? নাই।

মে ২০২১ লন্ডন