পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে ॥ শারমিন সাথী


বৃষ্টি।বৃষ্টি বিলাস।বৃষ্টি শব্দের সাথে বিলাস শব্দটা জুড়ে দিলে এর মাধুর্যই বেড়ে যায় অনেক গুণ।বৃষ্টি নিয়ে বিলাস,বৃষ্টির দিনে আনন্দ, বৃষ্টির দিনে ভোগান্তি সবার জীবনেই কম বেশি থাকে। তেমনি আমারও।

বৃষ্টি দেখতে দেখতে কত দিনের কত স্মৃতি যে মনে পড়ে যায়। আবার বৃষ্টির সাথে মাখামাখি করতেও কত আনন্দ। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন গ্রামে ছিলাম। এজন্য শহরের বৃষ্টি ও গ্রামের বৃষ্টির মধ্যে পার্থক্যটা বুঝি ।

মনে পড়ে, সকাল বেলার কড়া রোদ দেখে দাদী ও মা উঠোনে ধান শুকাতে দিতো। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে কোথা থেকে এক দল দামাল মেঘ আমাদের বাড়ির উঠোনের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় ধান ভিজিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠতো। যেন ধানের সাথে মেঘের আড়ি ।

দেখতাম, মা, দাদী এবং আরও যারা ছিল তারা মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘরে ধান উঠাতে শুরু করতো। আমিও তাদের সাথে যোগ দিতাম। যেন আমি না গেলে সব ধান বৃষ্টিতে ভিজে যাবে।

আমার দাদা বাড়িতে বাড়ির চারপাশ দিয়ে আম গাছ ছিলো। যখন অনেক ছোট ছিলাম তখন গাছে উঠতে পারতাম না। তাই আমের দিনে সারাদিন অপেক্ষায় থাকতাম গাছ থেকে কখন একটা আম পড়ে।

আমের দিন মানেই বৃষ্টির দিন। তাই যখন ঝড় বৃষ্টি হতো, খুশিতে মনটা ভরে উঠতো। ঝড়ের মধ্যে, বৃষ্টির মধ্যে আম কুড়াতে গেলে মা খুব বকা দিতো। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে আম কুড়াতে যেতাম। যখন বিদ্যুৎ চমকাতো, বজ্রপাত হতো তখন খুব ভয়ও পেতাম। ভয়ে বাঁশের মাচার নীচে লুকাতাম।

বৃষ্টির দিনে স্কুলে যেতে ইচ্ছে করত না। কিন্তুু যখন সবাইকে ঢাউস ঘুড়ির মতো ঢাউস ঢাউস মান কচুর পাতা মাথায় দিয়ে স্কুলে যেতে দেখতাম, আমার খুব লোভ হতো। তখন আমিও ঢাউস মান কচুর পাতা সংগ্রহ করে এক হাত দিয়ে মাথার উপর মান কচুর পাতা ধরে এবং অন্য হাতে বই নিয়ে স্কুলের পথে রওনা হতাম। জোরে বাতাস এলে কখনও কখনও হাত থেকে মান কচুর পাতা পড়ে যেত, বই ভিজে যেত। দৌড়ে গিয়ে তুলে এনে আবার মাথায় দিতাম। আমাদের স্কুলের বারান্দাটা ছিলো অনেক লম্বা। স্কুলে পৌঁছে বারান্দায় উঠতেই মনে হতো বাড়ি থেকে স্কুল পর্যন্ত সমস্ত রাস্তাটাই যদি এমন বারান্দার মতো হতো। উপরে ছাদ আর নীচে পাকা।

বৃষ্টির দিনের আরও একটি কথা মনে পড়ে গেলো। দল বেঁধে পুকুরে গোসল করতে নামতাম। সবাই মিলে ডুব পানি খেলতাম। আর আমি মাঝে মাঝে দলছুট হয়ে পানির নীচে ডুব দিয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনতাম।

টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে যেমন ভালো লাগে, তেমনি পানির নীচে ডুব দিয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনতেও অনেক ভালো লাগে। বর্ষাকালে নৌকায় চড়ে বাবার সাথে হাটে যেতাম। কত কি যে বাবা কিনে দিত। বাবা, মা, আমি ও আমার ছোট বোন নৌকায় চড়ে নানা বাড়ি যেতে যেতে কত আনন্দই না করতাম।

কখনও কখনও খুব বন্যা হলে বাড়ির উঠোনে পানি আসতো। উঠোনে আসা হাঁটু পানিরও কম পানিতে নেমে বাবার সাথে মাছ ধরতাম।

একটু বড় হওয়ার পরই শুরু হল শহুরে জীবন। শহুরে বৃষ্টি উপভোগের দিন। শহরে বৃষ্টির দিনে কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতা তৈরি হলেও দুর্ভোগ তেমন নেই বললেই চলে। আছে শুধু উপভোগ। কিন্তু, সেই উপভোগ চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী। জানালার ধারে বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে গ্রামের সেই দুরন্ত, দস্যি মেয়েটির কথা মনে পড়তে পড়তে চোখে জল অসতো।

একটা সময় পর সেসব দিনের কথা মনে পড়তো ঠিকই, কিন্তু চোখে আর জল আসতো না। তখন বৃষ্টি দেখার আনন্দ, বেদনা খুঁজে পেতাম বৃষ্টির ছড়ায়, কবিতায়, গানে। যেমন রবী ঠাকুরের কবিতায়, “দিনের আলো নিবে এল সূয্যি ডোবে ডোবে
আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে চাঁদের লোভে লোভে।”

নজরুলের গানে,
“শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে , নয়নে বারি ঝরে ”।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বৃষ্টি এলে সারা ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়াতাম বৃষ্টির মধ্যে। নিষেধ করার কেউ ছিল না। বরং উৎসাহ দেওয়ার অনেকেই ছিল। কখনও কখনও শাড়ি পরে একা একা বৃষ্টির মধ্যে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে সারা ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়াতাম। হল থেকে যেসব ছেলে মেয়েরা আমাকে দেখতো তারা নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবতো কী অদ্ভূত মেয়েরে বাবা।

এখন বৃষ্টির দিনে সকালে খিচুড়ি রান্না করি। বাসার গেটের ভেতর থেকেই গাড়িতে উঠে অফিসে যাই। বৃষ্টি লেগে কাপড় ভেজার কোনো সুযোগ নেই। বিকেলে অফিস থেকে ফিরে বেলকনিতে বসে চা খাই আর বৃষ্টি দেখি। আর ঘরের ভেতর বাজতে থাকে
“পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে ।”