জীবনের স্মৃতিদীপে ॥ সীমা শামীমা


অলঙ্করণ: লংরিড

জীবনের সবচাইতে সুন্দর ও আনন্দের স্মৃতি হলো স্কুল-কলেজ জীবনের স্মৃতি। আর সেই সময়ের বন্ধুরাই নিঃস্বার্থ ও অকৃত্রিম বন্ধু কারণ তখনো মানুষের মনে কিশোরবেলার সারল্য বাস করে। বৈষয়িক চাওয়া পাওয়া ততটা প্রবল হয় না।

আমার বন্ধু ভাগ্য খুবই ভালো। স্কুলজীবন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যে কয়জন ভালো বন্ধু পেয়েছি, অনেক মানুষ জীবনে ততজন ভালো মানুষও পায় না। সেইসব বন্ধু, সেইসব স্মৃতি আজো মনে হলে পুলকিত হই, নির্মল একটা ভালোলাগায় ছেয়ে যায় মনের আঙিনা।

তখন আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতই আমারো খুব কম বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। আমি যখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার শেষ করি, তখন আমার বিয়ে হয়। একেবারেই হুট করে বাবা-মায়ের পছন্দে। বিয়ের চারদিন আগে জীবনের শেষতম স্বাধীন দিনটি কাটানোর জন্য বা বন্ধুদের বিয়ের খবর ও দাওয়াত দেওয়ার জন্য কলেজে গেলাম। বন্ধুরা খবরটা শুনেই অবাক ! একটা স্তব্ধতা নেমে এলো। কেননা এর আগে আমার আর কখনো কোথাও বিয়ের কথা হয়নি। ইভেন এই বিয়ে ঠিক হওয়া অবধিও কেউ কিছুই শুনেনি। তখন তো আর মোবাইলফোন ছিলো না। আর গ্রামে ল্যান্ডফোনও ছিলো না। বন্ধুদের মধ্যে আমারই প্রথম বিয়ে হয়।

পড়াশোনায় মোটামুটি ছিলাম, বিয়ের নামধাম কেউ মুখেও আনেনি বা আনিনি।তাই অকস্মাৎ এই খবরে সবাই নিস্তব্ধ। আরও বেশি অবাক হয়েছিল সবাই যখন জানতে পারল যে আমার এ বিয়েতে ঘোর আপত্তি। না, প্রেম বা নিজস্ব পছন্দের কারণে নয়, আমি আসলে বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবিইনি। বিয়ে করবো এমন স্বপ্ন দেখতাম না তখন পর্যন্তও বরং স্বপ্ন দেখতাম পড়াশোনা করে চাকরি করবো আর বিয়ে করবো পরে কোন চাকরিজীবীকে। ইনফেক্ট আমি বিয়ের জন্য বা একটা সাংসারিক জীবনের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। তো এভাবে হুটকরে প্রবাসী কোনো পাত্রকে বিয়ে করার কথা ভুলেও ভাবিনি।

তাই কেবল মৌখিক প্রতিবাদ ছাড়া শক্ত কোনো অবস্থান নিতেও পারিনি। আর যেহেতু আমাদের রক্ষণশীল পরিবার তাই এর বেশি কিছু করাও সম্ভব ছিলো না। বাবা-মায়ের মুখে মুখে তর্ক করা বা তাদের অবাধ্য হওয়া শিখিনি। থাক সেসব কথা, আজ অন্যকিছু স্মৃতিকথা বলব।

গ্রামের কম্বাইন্ড স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করায় আমার বন্ধু-বান্ধবী ভালোই ছিলো। আমার এক বান্ধবী মর্জিনার বয়ফ্রেন্ড ছিলো ইউসুফ ভাই। সে আর এক কাহিনি। ইউসুফ ভাইয়ের টিম যখন হিমশিম খাচ্ছিল মর্জিনাকে রাজি করাতে, তখন জানতে পেরে আমি নিজে থেকেই কীভাবে যেন ইনভলভ হয়ে গেলাম। যেহেতু আমরা সবাই একই স্কুলে পড়তাম, ইউসুফ ভাই অবশ্য তখন কলেজে পড়তেন। সেই থেকে কত কী না করেছি মর্জিনাকে পটানোর জন্য।অবশেষে মর্জিনা আর ইউসুফ ভাইকে ফেরাতে পারেনি। ইউসুফ ভাই আমাদের সিনিয়র ছিলেন। যেহেতু তাদের প্রেমকাহিনির আমি ছিলাম প্রধান সমন্বয়কারী সেই সূত্রে ইউসুফ ভাইর সাথেও বেশ আড্ডা হতো। ইউসুফ ভাই ছিলেন খুবই চঞ্চল ও হাসিখুশি মানুষ। সারাক্ষণ মজা করতেন। আমরা সেই সময় ভীষণ মজা করতাম। ইশ! কী আনন্দেরই না ছিলো সেই দিনগুলো। একবার হয়েছে কী, ইউসুফ ভাই আর মর্জিনার মাঝে খুব মান-অভিমান হয়েছে, তখন আমরাও কলেজে পড়ি।

তো ইউসুফ ভাই অনুরোধ করলেন যাতে মর্জিনাকে বলে কয়ে দোতলায় থার্ডইয়ারের রুমে পাঠাই। ইউসুফ ভাই আগে থেকেই সেই রুমে গিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। রুমটি ছিলো দোতলায় কোণার দিকে, আর যেহেতু অফ পিরিয়ড, তাই নিরিবিলি ও নিরাপদ ছিলো, তো আমরা যথারীতি বন্ধুধর্ম পালন করলাম কিন্তু আমাদের সবার মনেই ছিলো ভীষণ কৌতূহল আর দুষ্টুবুদ্ধি। তাই আমরা দরজায় আড়িপাতি আর উঁকিঝুঁকি মারি ! সম্ভবত আমাদের আড়িপাতার বিষয়টা মর্জিনা আন্দাজ করতে পেরেছিলো। তাই খট করে দরজা খুলে রাগে গজগজ করতে করতে হনহন করে চলে যায়, আমাদের সাথে কথা না বলেই। ওদিকে বেচারা ইউসুফ ভাই ! সেও কিছুটা আহত হন।

ইউসুফ ভাইয়ের এক ইয়ারমেট ছিলেন, বারি ভাই। বারি ভাই ছিলেন আরও মজার মানুষ। বারি ভাইয়ের প্রধান কাজ ছিলো কলেজের পোস্টবক্স থেকে অন্যের চিঠি নিয়ে পড়া। বিশেষ করে লাভলেটার। তো সেইসব লাভলেটারের লেখা নানা রোমান্টিক কথা নিয়ে মজা করতেন। আর এমনই এক আসরে আমিও একদিন উপস্থিত হয়েছিলাম। ইউসুফ ভাই আমাকে বারি ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে, ‘এই সেই সীমা, যার বিয়ের কাহিনি তোকে বলেছিলাম ’। (ইউসুফ ভাই নাকি আমায় জোর করে বিয়ে দেবার ঘটনা নিয়ে বারি ভাইয়ের সাথেও আলাপ করেছিলেন, আর সেই থেকে নাকি আমাকে তার দেখার ইচ্ছে ছিলো।)

‘ও আচ্ছা, আপনি সীমা আপু? আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারিনি যে এ যুগেও মেয়েদের এভাবে জোর করে বিয়ে দেয়। সেই থেকেই আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। এ যুগেও এমন মেয়ে আছে!’ আজ থেকে সাতাশ বছর আগের কথা।

এভাবেই হয়েছিলো আমাদের পরিচয়। আজকের আমি আর সেদিনের আমিতে অনেক পার্থক্য ছিলো। তবে আমি তখনো এখনকার মতই স্পষ্টবাদী আর প্রতিবাদী থাকলেও ছিলাম খুবই লাজুক। সামান্য কথাতেও খুব লজ্জা পেতাম, আর লজ্জা পেলেই নাকি আমার মুখ লাল হয়ে যেতো। একদিন বারি ভাই একজনের লাভলেটার নিয়ে এলেন, আর সেই চিঠি জোরে জোরে পড়ে সবাইকে শোনাচ্ছিলেন। চিঠিতে একটা বাক্য ছিলো এমন, ‘পত্রে আমার ছোট্ট চুমু নিও ’। আর তা পড়ে হাসতে হাসতে শেষ। ‘আচ্ছা সীমা আপু আপনার তো অভিজ্ঞতা আছে, আপনি যদি এই ‘ছোট্টচুমু’র বিষয়টা ইকটু বুঝিয়ে দিতেন, মানে ছোটচুমু আর বড়চুমুর মধ্যে পার্থক্য কী কী ?

এই কথা শুনে আমি তো লজ্জায় শেষ। আর সেটা দেখেই বারি ভাইয়ের যুদ্ধ জয়ের উচ্ছ্বাস! ‘ইউসুফ! দ্যাখ, দ্যাখ! সীমাপু লজ্জায় কেমন আপেলের মত লাল হয়ে গেছে! ’ আর আমার মুখে তো কোন কথাই বেরুলো না লজ্জায়। সেই থেকে আমার লজ্জা পাওয়ার জন্যই মাঝেমাঝে বলতেন, ‘সীমাপু ! ছোট্টচুমু বিষয়টা যেন কী? আর আমি আবার লজ্জা পেতাম। ‘জানেন সীমাপু? আপনার এই লাজে রাঙা মুখটা দেখতেই আমি বারবার মজা করি।’ তবে আমাদের বন্ধুদের আড্ডা প্রেম ভালোবাসার আলোচনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকতো।

দিন যেতে থাকল আর আমি ও বারি ভাই বন্ধু হতে থাকলাম। একসময় বারি ভাই হলেন আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। কলেজে যেকোনো সমস্যা, বিপদে আর কোন বন্ধুদের পাশে না পেলেও তাকে পেতাম। লক্ষ্য করে দেখলাম বারি ভাই এলেই আমি আর বারিভাই গল্পে জমে গেছি। যদি আমার ক্লাস থাকতো আর অন্য বন্ধুদের না থাকতো, তো ওরা চলে যেতো কিন্তু বারি ভাই অপেক্ষা করে বসে থাকতেন, আমাকে বাজার পাড় করিয়ে রিকশায় তুলে দিয়ে তারপর তিনি যেতেন। বুঝতে পারলাম, বন্ধুমহলে একটা আড়চোখ জেগে উঠেছে। আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে লাগলাম।ওদিকে মর্জিনা আর ইউসুফ ভাইয়েরও টানাপোড়েন চলছে। সবাই কেমন যেনো ছাড়া ছাড়া হয়ে যাচ্ছি। তবে ছায়ার মতো পাশে থেকেছেন বারি ভাই।

বারি ভাই ছিলেন টনিকের মতো। জগতের কোনো হতাশা কষ্ট যেনো তাকে ছুঁতে পারে না। যত দুঃখ কষ্ট, হতাশা নিয়েই তার কাছে যেতাম না কেনো, তিনি ফুঁ দিয়ে যেন সব উড়িয়ে দিতেন। পাত্তাই দিতেন না কিছু, এমন চমৎকারভাবে সব ব্যাখ্যা করতেন যেন মনেহতো আসলেই তো !

জীবনে এত প্যারা নিয়ে লাভ কী ! যা হবার হবে। আমার জীবনে প্রকৃত কিছু শিক্ষা আমি তার কাছ থেকেই শিখেছি। কীভাবে নিজের দুর্বলতাকে ঢেকে না রেখে সহজ ভাবে সবার সামনে তুলে ধরা যায়, কী করে যে কোনো পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকা যায় , এসব আমি তার কাছেই শিখেছি। অবশ্য তখন আমার তেমন কোন চাওয়াই ছিলো না। আস্থায়, ভরসায় তিনিই হয়ে উঠেছিলেন বড়ভাই, বন্ধু, অভিভাবক । অপরদিকে বারি ভাইয়ের কাছে আমিও সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছি। আসলে সম্পর্ক একপাক্ষিক হলে তা আনন্দের বা সম্মানের হয় না। সম্ভবত আমার জীবনে বারি ভাইয়ের মতো সম্মান আমায় কেউ করেনি, এতটা মূল্যায়নও কেউ করেনি। তার মতো করে আমার আর কেউ বুঝেওনি। আমি ঋণী তার কাছে।

এরই মাঝে বারি ভাইয়ের জীবনে প্রেম হয়ে রীতা এলো। সেই রীতার কাছেও বারি ভাইয়ের প্রেমের পয়গাম আমাকেই পৌঁছে দিতে হলো। সে আর এক কাহিনি।

একদিন সকালে বাড়িতে ছোটভাই পা কেটে ফেলেছে, আমি ঘর থেকে স্যাভলন নিয়ে দৌড়ে বেরিয়েছি, আর কোত্থেকে তিনি সামনে দণ্ডায়মান ! আমি তো ভূত দেখার মতো চমকে গেলাম। চেহারা মলিন, চুলগুলো রুক্ষ, এলোমেলো। বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। তাকে ঘরে নিয়ে বসালাম। তিনি খাটে বসা থেকে শুয়ে পড়লেন, ‘সীমাপু ! আমি রীতাকে খুব মিস করি। মনেহয় আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি’। এর আগে অবশ্য রীতাকে নিয়ে অনেক কথাই হয়েছে। তাই আমিও বুঝলাম যে এবার সত্যি সত্যি তিনি প্রেমে পড়েছেন। রীতার আগেও বারি ভাই আরো কয়েকটি মেয়ের উপ্রে ক্র্যাশ খেয়েছিলেন।

একবার বারি ভাইয়ের সাথে তার এক ক্র্যাশকে দেখতে ও পটাতে মেয়ের গ্রামে গিয়েছিলাম। মেয়েটি ছিলো খুবই সুন্দর। নাম ছিল ‘ইমা’। কাজ হয়নি, মেয়েটিকে ততটা ইমোশনাল বা অ্যাডাল্ট মনে হয়নি আর মেয়েও কেমন যেনো আমতা আমতা করছিলো। আমার ভাল্লাগেনি। তারপর আরেকটি মেয়ে ছিলো সুরভি নামে। ইস কী সুন্দর ছিলো ! তোতা পাখির মতো বুঝিয়েও সেটাকে পটাতে পারলাম না। আমি হতাশ হতে থাকলাম ;আমি আসলে কোন কম্মেরই না। অবশেষে রীতাই মন জয় করে নিলো।

বারি ভাই আর রীতাদের ছিলো পাশাপাশি উঠান, পাশাপাশি ঘর, রীতাও বারি ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলো। ব্যাস হয়ে গেলো তাদের প্রেম। তাদের দীর্ঘ বারো বছরের প্রেমকাহিনিতে অনেক চড়াই উৎরাই এসেছে। রীতা আর বারিভাই দুজনেই বিশ্বাস আর ভালোবাসায় অটল থেকেছেন। বারি ভাই ছিলেন কন্যারাশি, কলেজে তরুণীদের হার্টথ্রব। একবার ঢাকায় এক মেয়ে তো তাকে পাবার জন্য বিষটিষ খেয়ে অস্থির। এইসব গোপন কথা বারি ভাই কেবল আমাকেই বলতেন। এরই মাঝে বারি ভাইয়ের কলেজ কোর্স শেষ হয়ে গেলো। বিকম পাস করলেন।

কলেজে আসা কমে গেলো। তিনি ঢাকায় থাকতে শুরু করলেন, আমি কেমন যেনো একা হয়ে গেলাম। বারি ভাইয়ের বোন ছিলো আমার ইয়ারমেট। ওর কাছ থেকে মাঝেমাঝে খবর পাই। বলাবাহুল্য, বারি ভাইয়ের বোনের চেয়ে বারি ভাইয়ের সাথেই আমার ঘনিষ্ঠতা ছিলো বেশি।

এরপর থেকে আমরা অপেক্ষা করতাম কবে আবার দেখা হবে ; কবে সব জমানো কথা একে একে বলব। কলেজে এসেই বারি ভাই বলতেন, ‘সীমাপু, আপনাকে এত্তগুলো কথা বলার আছে, অনেক মজার মজার কথা আছে’, (শ্রোতা হিসেবে আমি ছিলাম খুবই মনোযোগী)
‘আমারো অনেক কথা বলার আছে বারি ভাই।’
‘আচ্ছা, তাহলে আপনার কথাই আগে বলুন।’
এভাবেই আমরা গল্প করতাম, পস্পরের সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতাম। এর বাইরে অন্য কোনো সম্পর্ক আমরা ভুলেও মনে আনতে পারিনি। বারি ভাই বলতেন, ‘আপনি হচ্ছেন এমন একজন মানুষ যার কাছে এলে মন পবিত্র হয়ে যায়’। এরচেয়ে বড় সম্মান একজন মানুষের জীবনে আর কী আছে আমি জানিনা। আর বারি ভাই ছিলেন আমার আলোকবর্তিকা।

আমাদের সম্পর্কের মাঝখানে আমাদের অজান্তেই কে যেনো (হয়তো তাকেই শ্রদ্ধা অথবা বিবেক বলে) একটা অদৃশ্য লক্ষ্মণরেখা টেনে দিয়েছিল, যা আমরা কখনো অতিক্রম করিনি। যথাযথ সম্মান ও দূরত্ব বজায় রেখে একসাথে সমান গুরুত্ব নিয়ে পথ চলতে পেরেছিলাম।

আমাদের কত যে ছোট ছোট ইচ্ছে ছিলো, পূর্ণ হয়নি। রীতার ছিলো কড়া পাহারা আর আমার ছিলো রক্ষণশীল পরিবার। তাই ওকে নিয়ে কোথাও যেতে পারতাম না। কত প্রতিকূলতা যে ছিলো তাদের প্রেমে! আজকের দিন হলে এই প্রেম টিকতই না। তখন মোবাইল ছিলো না, চিঠিই ছিলো ভরসা। একটা চিঠি আঁকড়ে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিতেন, রীতাকে পরিবারের সন্দেহের বাইরে রাখার জন্য তিনি বাড়ি ছেড়েছিলেন। নানাবিধ চাপে মাঝেমাঝে উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে যেতেন, আমাকে পাঠাতেন খবর আনতে। আশ্বস্ত করতাম।বারো বছর প্রেম করা কি সহজ কথা!

রীতা পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে জয়েন করল, বাড়ি ভাই চাকরি করছেন, তবু রীতার পরিবার রাজি হচ্ছে না, এদিকে রীতাও গোঁ ধরে বসে আছে, বিয়ে করলে বারি ভাইকেই করবে নয়তো নয়। আর নিজে নিজেও বিয়ে করবে না। আমি সৌদি থেকে ফেরার দুই/তিনবছর পরে, (সৌদি ছিলাম তিনবছর তিনমাস)একদিন দুজনে এলেন আমার বাড়ি, কাজী সাহেব বাড়ির পাশেই ছিলেন,আমার বিয়াই (ভাসুরের মেয়ের শ্বশুর) বললাম ‘বিয়ে পড়িয়ে দেই।’ ‘না, আর কটা দিন দেখি।’ এভাবেই চলতে থাকল, অগত্যা রীতার পরিবার বাধ্য হলো বারি ভাইয়ের কাছে বিয়ে দিতে।

এদিকে আমার ডিগ্রি পরীক্ষার আগেই সাহেব আমাকে বিদেশ নেবার জন্য ভিসা পাঠিয়ে দিলেন। এটাও একদম হুট করে ! আর আমার ডিগ্রি পরীক্ষা দেওয়া হলো না ! ভিসা প্রসেসিংয়ের কাজে আমিও ব্যস্ত হয়ে গেলাম। দেখা, আড্ডা সব কমে গেলো।

তখন এমনই ঝড় বাদলের দিন ছিলো। হয়তো বৈশাখ বা জ্যেষ্ঠ মাস হবে। বিদেশে যাবার আগে একদিন বিকেলে কী যেনো একটা দরকারে আমি শ্রীনগর এসে তার আড্ডার সবকটা জায়গায় খুঁজলাম। না পেয়ে হাঁটা শুরু করলাম তার বাড়ির দিকে। আমাকে বাড়িতে দেখে তো অবাক। অবশ্য এর আগেও তাদের বাড়িতে গিয়েছি, তাই সবাই পরিচিত।

একদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হতে চলল, অন্যদিকে আবার মেঘের খুব সাজগোজ শুরু হলো। অল্প সময়ের মধ্যেই কালো আঁধার ঘনিয়ে এলো। আমি ভয় পেয়ে গেলাম।কারণ আমার বাড়ি ফিরতে ফিরতে তো সন্ধ্যে বয়ে যাবে তারউপর আবার এমন ঝড়ের সাজ। যেহেতু তখন মোবাইল ছিলো না তাই বাড়িতে খবর দেবার কোন উপায়ও ছিলো না। মা চিন্তা করবেন এবং ভীষণ বকুনি দিবেন। এই ভয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলাম। আন্টি বারি ভাইকে বললেন আমায় এগিয়ে দিতে। বারি ভাই আমাকে দেউলভোগ উপজেলা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন, এখান থেকে রিকশা নিতে হবে। কিন্তু ঝড়ের ভয়ে বা অন্য কারণে সেখানে কোন রিকশা ছিলো না। এদিকে চারদিক আঁধার হয় হয়, আকাশ ঘন মেয়ে ছাওয়া। কী করি? অগত্যা হেঁটেই রওনা দিলাম। বারি ভাইও ফিরে গেলেন!

আকাশে ঘনকালো মেঘ নিচে পিচঢালা কালো রাস্তা, একেবারে ভয় জাগানিয়া একটা পরিবেশ! আমার খুব অভিমান হলো, কেনো তিনি আমার সাথে এলেন না, এমন ঝড়বাদলের দিনে ভর সন্ধ্যায় তিনি কী করে আমায় একা ছেড়ে দিলেন ! কেনোনা অনেকটা পথ হাঁটতে হবে, অর্ধেক রাস্তা আসার পর শুরু হলো ঝড়। হায়! কী বাতাস! যেনো আমায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে! নির্জন রাস্তা, পথের দুধারে কোন বাড়িঘর নেই,কেবল চক আর চক (বিল) , কোন লোকজন নেই ! হায়! কী ভয়টাই না পেয়েছিলাম। ভয়ের চেয়েও বেশি অভিমান আর কষ্টে হাতপা কাঁপছিলো ! তবু দৌড়ে হেঁটে অনেকটা পথ এলাম। ষোলঘর বাজারের পর থেকে মাটির পথ আর তা খুবই বাজে। কী যে কষ্টে সেই পথ পাড়ি দিয়েছিলাম তা জানে ঈশ্বর ! বৃষ্টিতে পিচ্ছিল হয়ে ছিলো সারাটা পথ।

ততক্ষণে পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেছে। এখন আকাশ, সন্ধ্যা আর আমার মন সব যেনো একই ব্যথায় আর্তনাদ করছে। কেবল একটি প্রশ্নই বাজছে মনে, ‘কী করে এমন ঝড়ের মধ্যে আমায় একা ছেড়ে দিতে পারলেন?’ চোখের জলে বৃষ্টির ফোঁটা মিশে ভারি করে তুলেছে অশ্রুভার ! ‘পরিচয়ের পর থেকে আমাকে সবরকম ঝড় থেকে যিনি আগলে রেখেছেন, তিনি কী করে আজ এই ঝড়ে আমায় একা ছেড়ে দিলেন? ’

বাড়ির অল্প দূরে আমাদের সদারাম পুর প্রাইমারি স্কুল। সেখানকার এক পরিচিত বাড়ি থেকে হারিকেন নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে, কাদায় মাখামাখি হয়ে সন্ধ্যার পর আমি বাড়ি ফিরি। মাকে বললাম, ঝড়ে আটকে গিয়েছিলাম। মা বকুনি দিলেন,কেনো আরো আগে রওনা দিলাম না, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি নিজেই কষ্টে কুকড়ে যাচ্ছিলাম। মা’র বকুনি আমায় আর কী বা বিদ্ধ করবে ! সেদিনের পর অনেকদিন পর্যন্ত মন খারাপ ছিলো, অভিমান ছিলো। সেই প্রশ্নটা তাকেও করলাম, আপনাকে আমি বড়ভাই বলি, আপনিও আমায় বোনের মতো বলেন, আসলে সত্য এটাই যে আমরা ভাইবোন না। আজ যদি আমার জায়গায় আপনার নিজের বোন হতো, আপনি কি পারতেন এমন ঝড়ের কবলে ওকে একা ছেড়ে দিতে?

সেদিন উত্তরটা পাইনি ! শুধু এটুকু বুঝেছিলাম যে তিনিও আহত হয়েছিলেন মনে মনে । উত্তরটা দিয়েছিলেন আমি বিদেশ থেকে ফেরারও পাঁচ-ছয় বছর পর।